‘আরে সাইফু দোস্ত যে!’ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল।
ভাবনার তারটা ‘টুন্’ করে ছিঁড়ে গেল সাইফুলের। জাস্ট একটা ছন্দপতন হলো যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। প্রথমে চিনতে পারল না। তারপর ক্রমে ওর সমস্ত চেহারায় খুশির একটা রং খেলে গেল। আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠে গিয়ে দাঁড়াল আগন্তুকের সামনে। তারপর দু’হাত প্রশস্ত করে তাকে টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। আর বলতে থাকল, ‘দোস্ত হাবুল, কিরম আছিসরে তুই? কত দিন পর দেখা ক’তো? ওহ্! আমার যে কী ভালো লাগতেছে, তা তোরে বুঝায় ক’তি পারবো না। আয়, বয় (বোস)। আজ পরান খুলে গল্প করবো দুই দোস্ত।’
একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে তারপর থামল সাইফুল। হাবুলকে প্রায় টেনে শিমুল গাছের মোটা শিকড়টার ওপরে বসাল। নিজেও পাশে বসল।
হাবুল এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে ওর কথা শুনছিল আর কান্ড-কারখানা দেখছিল। এক্ষণে বলল, ‘এই যে একসাথে এত্তোগুলো কথা ক’লি, আমি এখন কোনটে থুয়ে কোনটের জবাব দেব তুই-ই কয়ে দে।’
‘দোস্ত, তুই রাগ করিছিস হাবুল? আসলে হয়েছে কী...’
‘থাক থাক, তোরে আর কিছু ক’তি হবে না।’ সাইফুলকে থামিয়ে দিয়ে বলল হাবুল। ‘শুনলাম তুই আইছিস, তাই আর থাকতি না পেরে দেখা কত্তি আসলাম। তা থাকবি কয়দিন?’
‘এবার সহজেই যাচ্ছিনেরে হাবুল।’ বলল সাইফুল। ‘লম্বা ছুটি নিয়ে আইছি। একটা বিশেষ কাজে আইছি কি-না!’
‘ও!’
বলেই কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল হাবুল। সাইফুল তা খেয়াল করল না। ওর যেন আজ কথার জোয়ারে পেয়ে বসেছে। তাই বলে চলেছে, ‘আসলে ঢাকা শহর এখন আর বসবাসের উপযোগী নেই রে দোস্ত। চারিদিকি খালি গ্যাঞ্জাম আর গ্যাঞ্জাম। সারাদিন গাড়িঘোড়ার শব্দ শুনে শুনে কানটাই গেছে নষ্ট হয়ে। কোনো কাজের উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হলি ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম আর সিগনালে পড়ে থাকতি হয়। তুই যদি নির্দিষ্ট সুমায় কোথাও যাতি চাস, তা’লি অন্তত দুই ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টা সুমায় হাতে নিয়েই তবে বেরোতি হবে। যত না সূর্যের তাপের গরম, তার থেকে বেশি গরম মানুষের জন্যি, বুঝলি? চারপাশে খালি মানুষ আর মানুষ। গিজগিজ গিজগিজ করে। আর উঁচো উঁচো দালানের কথা তো ক’য়াই লাগে না। একটার সাথে যেন আরেকটা পাল্লা দিয়ে খালি উপরের দিকি উঠতি চায়। কয়দিন আগেই তো খবরের কাগজে আর টিবিতে দেখিছিস কয়টা দালান হেলে পড়েছে। লোকজন সব সেখান থেকে পলাচ্ছে। বিশ্বাস কর, তুই শত চিষ্টা করেও নীল আকাশের দেখা সেখেনে পাবিনে। পেজা তুলোর মতো সাদা মেঘের উড়ে বেড়ানো আর তার সাথে গাংচিল ও সাদা বক কিংবা অচিন পাখির উড়ে যাওয়া দেখার আশা তো দুরাশাই। পাখির ডাক? উঁহু, কক্ষনো সে চিন্তা করাও যাবে না। তবে একটা পাখির ডাক তুই ঠিকই শুনতি পাবি। ক’তো কী পাখি...’ পাশ ফিরে হাবুলকে অন্যমনস্ক দেখে কথা বলা থামিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, ‘এই হাবুল, দোস্ত, তুই কি আমার কথা শুনছিসনে? দূর! এতক্ষণ তা’লি আমি কার সাথে কথাগুলোন ক’লাম? হাবুল, এই হাবুল?’
ওকে ধরে ঝাঁকি দিল সাইফুল। তাতে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল হাবুল। বলল, ‘উঁ! না মানে হঠাৎ যে কী হলো না, আমি যেন কেমন, মানে...’
অবাক হলো সাইফুল। শঙ্কিত হয়ে উঠল। চেহারায় তার পূর্ণ অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। বলল, ‘কোনো প্রবলেম দোস্ত? ক’বি তো, আমারে তো সব খুলে ক’বি নাকি!’
‘না কিছু না, ওই হয়েছে কী, আসলে...’ আমতা আমতা করতে লাগল হাবুল।
‘দেখ,’ বলল সাইফুল। ‘আমি গিরামে আইছি একটু রেস্ট নিতি। খোলা আকাশের নিচেই নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ার জন্যি আমি সেই ঢাকা থেকে ছুটে আইছি। এই সেই শিমুল গাছ, শীতির ভোরে যে গাছের তলা থেকে ফুল খুটে নিয়ে গিছি সুমার মারে খাওয়ানোর জন্যি। সুমার মা ছিল আমাদের সবচেয়ে ভালো ছাগলডা। প্রতি বছর তিনটে করে বাচ্চা দিত ছাগলডা। এই পুকুরি কতো সাঁতার কাটিছি আমরা, ডুব দিয়ে ধরাধরি খেলিছি। আর কাটা ঘুড়ির পিছনে ছুটতি ছুটতি উঠে গিছি কুঞ্চি ভরা বাঁশ গাছে। একবার মনে আছে, এই শিমুল গাছের সবচে’ উপরের ডালে বাঁধল তে-রঙা ঘুড়িডা? তুই আমারে জোর করে ঠেলে উঠিয়ে দিলি গাছে। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে আমি ঠিকই উঠে গিলাম। তারপর যখন ডাল থেকে আলগা করে ঘুড়িডা নিচেই ছেড়ে দিলাম, তখন সেটা তোর হাতে না গিয়ে পড়ল পুকুরডার মধ্যিখানে। আমি কানতি কানতি গাছ থেকে নেমে আসলাম। তুই আমারে সান্ত্বনা দিলি।...’
আরও অনেক কথাই বলত হয়তো সাইফুল, কিন্তু হাবুলের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘খারাপ কিছু হয়েছে তোর?’
হাবুল মুখে কোনো কথা না বলে উপর-নিচ মাথা নাড়াল কেবল।
সাইফুল বলল, ‘আমারে ক’বি কী হয়েছে?’
‘ক’তি ইচ্ছে কচ্ছে না।’
‘তা’লি আমার সামনে মুখ গুমড়া করে রইছিস কেন? তুই কি চাস আমি আজই ঢাকায় চলে যাই?’
‘না।’
‘তা’লি চল, গিরামডা একটু ঘুরে আসি।’
‘কনে কনে যাতি চাস তুই?’
‘সব জায়গায়, আমরা একসাথে যেখেনে যেখেনে যাতাম, সেই সব জায়গায় যাব। আমার তো অনেক জায়গার কথা মনেই নেই। তোর তো মনে আছে। কোনো জায়গা বাদ দিবিনে কিন্তু, সব জায়গায় নিয়ে যাবি। আর যাতি যাতি তোর কথাও শোনবো। ...চল এবার।’
উঠে দাঁড়াল সাইফুল। উঠল হাবুলও। তারপর হাঁটতে শুরু করল।
সাইফুল আর হাবুল, এক সময় খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল ওরা। ওদের আর এক বন্ধু ছিল রনি, বছর তিনেক হলো ক্যান্সারে মারা গেছে। এই তিনজন মিলে একসময় গ্রামটাকে মাতিয়ে রাখত। গ্রামের লোকেরা যেমন ওদের নিয়ে অতিষ্ট হতো, তেমনি উপকারও পেত। তাই ওদের বিরুদ্ধে শত নালিশ থাকলেও সবাই বেশ পছন্দই করত ওদের।
রনিটা বেশ রোগা ছিল। একেবারে টিংটিঙে শরীর ছিল ওর। সাইফুল তো ঠাট্টা করে প্রায়ই বলত, ‘তোকে ফেলে দিতি কোনো ঝড় লাগবে নারে রনি, ফাঁকা মাঠে দাঁড়ালি হালকা একটু বাতাসেই তুই চিৎপটাং হয়ে যাবি।’
‘এহ্,’ সাইফুলের কথা শুনে বলত রনি। ‘বললিই হলো! এই আমি শক্ত হয়ে দাঁড়ালাম, মার তো ধাক্কা দেখি ফেলতে পারিস কি না?’
সাইফুল কিন্তু ওকে ধাক্কা মারত না। পাছে সত্যিই পড়ে যায়। আসলে বন্ধুকে ও ছোট করতে চাইতো না কখনও। এই বিষয়ে যখন প্রায়ই ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতে থাকল, তখন একদিন অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধাক্কা মারল সাইফুল। ধাক্কাটা বেশ জোরে না হলেও মোটামুটি জোরে ছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! তালপাতার সেপাই রোগা পটকা রনিকে একচুল নড়াতে পারল না ও। এরপর থেকে ওকে খেপানো বাদ দিতে হলো ওকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সাইফুল। বলল, ‘তোর মনে আছে হাবুল, যেদিন আমি ধাক্কা মেরে রনিটারে একচুলও নড়াতে পারলাম না, সেদিনই ও বলেছিল, ‘তুই আমারে ফেলতি পাল্লিনে ঠিক আছে। কিন্তু দেখিস, আমি ঠিকই একদিন পড়ে যাব। সেদিন তুই হাজার চিষ্টা করেও আমারে উঠানো তো দূরির কথা, সুজা করেই রাখতি পারবিনে।’ আমি ওর কথা হেসেই উড়িয়ে দিলাম। ও তখন বলল, ‘আমি সত্যিই একদিন তোদের ছেড়ে চলে যাবরে দোস্ত। সেই দিনটির কথা মনে হলি আমার খুব কান্না পাই। আমি আর বাঁচবো নারে সাইফুল।’ হাবুল, আমি, আসলে...’
সাইফুলের চোখের কোণটা ভিজে উঠল। নিজের অজান্তে দু’গ বেয়ে দু’ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে নেমে গেল। সে অশ্রুটুকু মোছার কোনো চেষ্টা না করেই বলল, ‘ও একদিন ঠিকই আমাদের সবাইরে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। সত্যিই ওরে সুজা করে রাখা গেল না। আমি তো ওরে শেষ দেখাডাও দেখতি পাল্লাম না। আমি, আমি ওর এই কবরের সামনে দাঁড়ায় স্থির থাকতি পাচ্ছিনেরে হাবুল। আমি, আমি....’
আর কোনো কথা বলতে পারল না সাইফুল। কান্নায় ওর কণ্ঠ বুজে এল।
হাবুল ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘রনির জন্যি আমারও মেলা খারাপ লাগে। কিন্তু আমাদের কিইবা করার ছিল ক’। ওর ভিতরে যে কঠিন রোগ ডানা বেঁধে উঠছিল তাকি ও কাউরে জানতি দিয়েছে? দেয়নি। এখন আর কেন্দে লাভ নেই। তারচে’ আয়, ওর জন্যি আমরা মাবুদের দরগায় দুয়া করি, ও যেন পরকালে সুখি থাকে।’
দু’হাতের তেলো দিয়ে চোখের পানি মুছল সাইফুল। তারপর দু’হাত তুলে প্রিয় বন্ধুর জন্য প্রভুর দরবারে ধরনা দিল। এবার শুধু সদ্য শুকানো দু’গ ই না, সমস্ত মুখ-বুক ভাসিয়ে ফেলল চোখের নোনা পানিতে।
* * *
আজ রাতের বাসেই ঢাকা যাবে সাইফুল। যাবার আগে হাবুলের সাথে দেখা করল। এর আগেই ও হাবুলের সমস্যাটার কথা জেনেছে। কিছু পরামর্শও দিয়েছে। আজ চূড়ান্ত একটা পরামর্শ দিয়েই তবে ঢাকা যাবে বলে ঠিক করেছে। তাই এই দেখা করা।
গ্রামে হাবুলের একটা মুদি দোকান আছে। বুড়ো বাপ এখন আর পেরে ওঠেন না। তিনি সমর্থ্য থাকতে হাবুলকে সংসার নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু একটা ব্রেন স্ট্রোকের পর শরীরের বাঁপাশটা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার পর সংসারের হাল তাকেই ধরতে হয়। তাছাড়া পরিবারে একটা মুখ বেড়েছে, এখন তার মুখেও খাবার জোগাতে হয়। তাই একপ্রকার অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাবার মুদি দোকানটা ওকেই দেখাশোনা করতে হয়। নইলে ইচ্ছা ছিল শহরে গিয়ে কোনো ব্যবসা-ট্যবসা করবে। সেজন্য কিছু পুঁজিও ম্যানেজ করেছিল। কিন্তু এখন সেসব চিন্তা একপ্রকার বাদ দিয়ে বাবার দোকানটা নিয়েই পড়েছে। বাবার ওষুধ আর ছেলের ডাক্তার খরচ দিতে দিতে হাবুলের এখন অবস্থা খুবই খারাপ। শহরে গিয়ে ব্যবসা করার জন্য যে পুঁজিটা ও সংগ্রহ করেছিল, সেটাও শেষ হয়ে গেছে কয়েক মাস হলো। তাই এর ওর কাছ থেকে ধারদেনা করে দোকানে মাল তুলল কয়েক মাস। কিন্তু পুঁজি ধরে রাখতে পারল না। ফলে দিনে দিনে দেনা বাড়তে লাগল ওর।
আলিমুদ্দিন দফাদার গ্রামের একজন বেশ সমর্থ্য মানুষ। বিপদে-আপদে গ্রামের মানুষ সবার প্রথমে তার কাছেই ছুটে যায়। হাবুলও গিয়েছিল। তবে কথা হয়েছিল, সামনের আমন সিজনে ধান কাটার সময় টাকাটা শোধ দিতে হবে। এখন সেই সময় প্রায় চলেই এসেছে। ইতিমধ্যে বার দুই তাগাদাও দিয়েছে আলিমদ্দি। ওদিকে অন্য পাওনাদারেরাও টাকার জন্য চাপ দেয়া শুরু করেছে। দুই-তিন দিন ধরে ছেলেটার কাঁশিও দেখা দিয়েছে। শহরে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাতেও বেশ টাকা লাগবে। সব মিলিয়ে বেশ ঝামলোয় পড়ে যায় হাবুল। অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে অভিনয়টা করতেই হলো ওকে। গ্রামের দক্ষিণের যে লম্বা দু’টো তালগাছ নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী লোকের মুখে মুখে প্রচলিত আছে, সেই তালগাছকে উপলক্ষ করে একটা কেচ্ছা বানিয়ে ফেলল ও। এতে অন্তত কিছুদিন পাওনাদারদের তাগাদা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। সেই অনুযায়ীই সেদিন রাতে ওখানে ভূতের ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার ভান করল। মিরাজকে সাথে নিয়ে এমনভাবে কাজটা সম্পন্ন করল যে, মিরাজও একেবারে বিশ্বাস করে ফেলল যে হাবুলকে সত্যিই ল্যাংড়া জিনে আঁছড় করেছে। সে তাই সফলভাবেই বিষয়টা গ্রামময় প্রচার করে দিল। কিন্তু বাঁধ সাধল আলিমদ্দি দফাদার। ঘটনার কথা শুনে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই তো ছুটে এসেছে হাবুলের বাড়ি এবং কৌশলে সব বের করে নিয়েছে। এখন তাই মহা ঝামেলায়ই পড়ে গেছে হাবুল। আর কারোর না হোক, দফাদারের টাকাটা ওকে শোধ করতেই হবে। অবশ্য সাইফুলকে সব বলতে চায়নি ও। কিন্তু সাইফুল নাছোড়বান্দার মতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সব জেনে নিয়েছে।
‘এখেনে হাজার চল্লিশের মতো টাকা আছে,’ পাঁচশ টাকার একটা বান্ডিল হাবুলের জামার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল সাইফুল। ‘আলিমদ্দি দফাদারের টাকাটা আগে দিয়ে দিস। তারপর বাবুরে শহরে নিয়ে গিয়ে ভালো একটা ডাক্তার দেখাবি। এরপর অন্যদের টাকা শোধ দিবি। মনে হয় তারপরেও কিছু টাকা বেঁচে যাবেনে। তা দিয়ে দুকানে মাল তুলিস।’
হাবুল প্রথমে কিছুই বলতে পারে না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে তার সে চোখে শূন্য দৃষ্টি।
তা দেখে সাইফুল আবার বলল, ‘আরে কী দেখতিছিস এমম করে?’
‘না মানে তুই, মানে তোর টাকা...’
‘ও এই কথা? আরে দোস্ত, আমি তো একটা ঘর তুলার জন্যি টাকাটা নিয়ে আইলাম। তুই তো বউ-ছওয়াল নিয়ে ভালোই আছিস, আমিও চাইছিলাম তোর একটা ভাবি ঘরে আনতি। কিন্তু টাকাটা তো তোর এখন খুবই প্রয়োজন। আগে তো তোর প্রয়োজনটা মিটুক, ঘরটা না হয় আরও কিছুদিন পরেই হবেনে, আর তোর ভাবিও ততদিন অপেক্ষা কত্তি থাকুক।’
‘দোস্ত আমি তোর এই ঋণ কোনোদিন শোধ কত্তি পারব না।’ চোখজোড়া ছলছল করে উঠল হাবুলের।
দু’হাতে হাবুলের দু’কাঁধ ধরে মৃদু ঝাঁকি দিল সাইফুল। বলল, ‘আরে শালা টাকাটা কি আমি তোরে একেবারেই দিয়ে দিচ্ছি নাকি? সুমায়-সুযোগ মতো শোধ দিয়ে দিবি। এখন আসিরে, গাড়ির সুমায় হয়ে যাচ্ছে।’
হাবুলের চোখের দু’ফোঁটা তপ্ত লোনা পানি গন্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে ওর ফুলে ওঠা জিহ্বায় পড়ল। তাতেই যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। বলল, ‘আজ তোরে বিদায় দিতি একদম ইচ্ছে ক’চ্ছে না। আজ থেকে যা-না!’
‘নারে দোস্ত, তা হয় না।’ বলল সাইফুল। ‘জানিসই তো প্রাইভেট কোম্পানি। নানান ঝামেলা সব সুমায় লেগেই থাকে। আমি যাই রে।’
‘ভালো থাকিস।’ বলল হাবুল।
হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করল সাইফুল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না।
মায়ের ইচ্ছাকে কবর দিয়ে যাচ্ছে ও। ছুটি শেষ হতে এখনও দিন চারেক বাকি আছে। তার আগেই ও চলে যাচ্ছে। মূলত মায়ের চিঠি পেয়েই ও বেশি করে ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছিল। কিন্তু যখন শুনল প্রিয় বন্ধুর দুরবস্থার কথা, তখন নিজের সাথে বেশ করে ... ও। অবশেষে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানোই স্থির করল। রনিকে হারিয়েছে ও, শেষ দেখাটাও দেখতে পায়নি। তাই হাবুলকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখার জন্য মায়ের চাওয়াকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হয়েছে। আর নিজেকেও কি ঠকায়নি ও? তা তো অবশ্যই ঠকিয়েছে। ঠকিয়েছে মাকেও।...
নাহ্, আর ভাবতে চাইল না সাইফুল। সময় নিয়ে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ও। এই নিঃশ্বাসের সাথে বের করে দিতে চাইল সদ্য দেখতে থাকা সোনালি স্বপ্নের রেশটা। আপাতত অঙ্কুর অবস্থাতেই ঘুমিয়ে থাক ওটা। পরে সময় মতো জাগিয়ে নেয়া যাবে।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর দ্রুত পা চালাল সামনের দিকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন