যখন আমি ৫ম শ্রেণীর ছাত্র তখন একদিন সন্ধ্যা বেলা মেঝ মামা বড় দুটি ব্যাগ হাতে করে বাসায় আসলেন । মা জিজ্ঞাসা করলেন কোথা থেকে আসলি? মামা বললো সিলেট গিয়েছিলাম এবং এরপর একের পর এক বলতে লাগলেন তার ৫ দিনের সিলেট ভ্রমণের আশ্চর্যরকম গল্প। মামা বললেন জাফলংয়ের পাথর বাচ্চা জন্ম দেয় এবং মাধবকুন্ডে ৮০ ফুট উপর থেকে শুকনো মাটির পাহাড় ফেটে পানি ধারা বয়ে নিচে নেমে আসে। ঠিক তখন থেকেই আমার মধ্যে প্রচন্ড রকম কৌতুহল জাগে কিভাবে পাথার বাচ্চা দেয় এবং মাটির পাহাড় থেকে পানি পড়ে।
অবশেষে সেই ছোট বেলার সাধ অর্থাৎ ১৩ বছরেরর জল্পনা, কল্পনা অবসান ঘটে ২০১১ সালের ১৬ মার্চ। প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি শিাঙ্গন পাঠক ফোরামকে, যে বৃহৎ সংগঠনটি না থাকলে হয়তোবা আমার পে কখনোই সিলেট যাওয়া হতো না। একটি কথা না বললেই নয় যে শিাঙ্গন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিকাংশ শিক- শিকিা ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
যাই হোক ১০ ই মার্চ সকাল বেলা ফোরামের সকল দায়িত্বশীলদের সাথে শিা সফরে যাবার যাবতীয় পরিকল্পনা ঠিক করে নিই। আমাদের সফর ছিল ৩ দিনের ১৬-১৮ ই মার্চ পযর্ন্ত। তিন দিনের জন্য একটি সুপার বাসের সাথে সকল যোগাযোগ শেষ করে নিই। ১৬ তারিখ রাত ১২ টায় সদরঘাট থেকে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের সফর সঙ্গী ছিলেন শিাঙ্গন সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি শাহীন আহমদ খান এবং অন্যতম সম্পাদনা নির্বাহী খন্দকার হাসিবুল ইসলাম। সফরের শুরুতেই আমাদের অঞ্চলের সেক্রেটারী মনোয়ার হোসেন আমার নাম ঘোষণা করেন সকল শিার্থীকে সফরের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী ঘোষণা করার জন্য। তারপর শুরু হলো গান কৌতুক হাসি আরো কত কি? সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছেন ওরা দু’জন একজন আমারই সহোদর বি.বি.এ. পড়–য়া জহির ও অন্যজন মুকিত। এভাবেই রাতে আধরি পেরিয়ে চলে এলাম সিলেটের মৌলভীবাজার। ভোর বেলায় মৌলভীবাজারের একটি সুন্দর মসজিদে সবাই ফজরের নামাজ আদায় করি। গাড়ির চাকা আবার ঘুরতে লাগলো হযরত শাহ্জালাল (র) ও শাহ্ পরাণের মাজারের উদ্দেশ্য। অল্পণের মধ্যেই পৌছে যাই ছোট বেলার সেই কাঙ্খিত স্বপ্নের ভুবন সিলেটে। প্রথমেই হযরত শাহজালাল এবং পরে শাহ পরাণ মাজার। ভিন্ন রকম এক অভিজ্ঞতা হলো সেখানে। এক শ্রেণীর অর্থ লোভী মুখোশধারী মুসলমান কিভাবে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ল ল টাকা। যা এ দুটি মাজারে না গেলে হয়তোবা বুঝা যেতোনা। অতপর আমরা চললাম জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে। রাস্তার চারপাশে বিশালাকার উঁচু নিচু পাহাড় রাস্তাগুলো বয়ে চলছে আঁকাবাকাঁভাবে। সত্যিই এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সিলেট। বার বার শিার্থীদের আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দিচ্ছিল। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করে। ২ ঘন্টা পথ পাড়ি দেবার পর আমরা জাফলং বাসস্ট্যান্ডে পৌছলাম । সেখানে গোছল করবো বলে সবাই জামা কাপড় সাথে নিয়েছিলাম । বিশাল আকৃতির এক রহস্যময় পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলে আঁকাবাঁকা পানি পথ। যে পানিতে পাথর বাচ্চা দেয়। প্রতিনিয়ত সরকার এখান থেকে ল ল টন পাথর উত্তোলন করছে। শুনেছি কেয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ার মানুষ পাথর উত্তোলন করলেও সেখানে পাথর শেষ
হবে না। জাফলং নদীর পাশেই রয়েছে ভারতীয় সীনন্ত। স্ব-চোখে দেখে এলাম ভারতীয় বি.এস.এফ. নামক রক্তপিপাসু নর পিশাচদের যারা প্রতিনিয়তই আমাদের ভাই বোনদের রক্ত ও জীবন নিয়ে হলি খেলায় মেতে উঠে। আমরা প্রায় ২ ঘন্টা যাবত সবাই সেখানে গোসল করলাম এবং অনেক মজা করলাম। জোহরের নামাজ এবং দুপুরের খাবার শেষে এবার যাত্রা শুরু চা বাগানের দিকে । সিলেটের সবচেয়ে বড়- চা বাগান ‘লাক্কাতুরা ন্যাশনাল টি গার্ডেন’ । সেদিন আবার চা-বাগান বন্ধ ছিল । তারপর আমার নানা ঐ চা বাগানের এম.ডি. হওয়ার কারনে আর কোন বাধা রইল না ঘুরে বেড়াতে।
সাত একর জমি নিয়ে তৈরি এ চা বাগান ঘুরতে কমপে দু দিনই লেগে যাবে। আমাদের সময়ের সল্পতার জন্য সেই কাজটিই কিনা ২ ঘন্টার মধ্যে আশে পাশে ঘুরে দেখে শেষ করতে হলো। নিকটবর্তী মসজিদ থেকে সবাই মাগরিবের নামাজ শেষ করে ৪ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে মাধবকুন্ডে পৌছলাম। রাতের খাবার শেষ করে এশার নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ আগামীকাল অনেক জায়গা দেখার বাকী। সে যাই হোক পরদিন ফজর নামাজের মাধ্যমে শুরু হলো দিনের ব্যস্ততা। সকালের নাস্তা শেষে বেরিয়ে পড়লাম মাধবকুন্ডের উদ্দেশ্যে। আমরা ৩টি গ্র“পে বিভক্ত হয়ে মাধবকুন্ডের ভিতর প্রবেশ করলাম। কিছু পথ পাড়ি দেওয়ার পর চোখে পড়লো বিশাল আকৃতির এক পাহাড় যার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছে অপরূপ ঝরণাধারা। সবশেষে বের হলাম শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আমরা জোহর নামাজ এবং আসরের নামাজ শেষ করলাম। শ্রীমঙ্গলের চা বাগানর আরো সুন্দর ও মনো মুগ্ধকর যা সত্যিই বিষ্ময়কর। এখানেই সর্বপ্রথম ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চা গবেষণা ইনিষ্টিটিউশন। আমরা সেটাও পরিদর্শণ করলাম। বেলা যখন ৪ টা সাবর পেটে তখন েিধ আর পানির তৃষ্ণা । তাই দেরি না করে বেরিয়ে পড়ি । পথিমধ্যে দুপুরের খাবার শেষ করে আবার গাড়ির চাকা ঘুরতে লাগলো ঢাকার উদ্দেশ্যে।
বর্ণিল ও বিত্রিময় এ মানব জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে শিা। বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য এ সময়টুকু সবচেয়ে বড় শিা। ভ্রমণ মানব জীবনকে জ্ঞানের ধারায় শাণিত করে। ব্যক্তি জীবনকে করে গতিশীল ও চটপটে। নিজের জীবন হয়ে উঠে বাস্তব জ্ঞানের এক পূর্ণাঙ্গ ভান্ডার । ভ্রমণের মাধ্যমেই স্রষ্টার প্রকৃত সৃষ্টি সর্ম্পকে জানা য়ায় । মুসলিম বিশ্বের অন্যতম মহাকবি শেখ সাদী (রহ) ৯৯ বছর বয়সের মধ্যে ৩৩ বছর ভ্রমণ করেছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া একবার বাংলাদেশে ভ্রমণ শেষে বরিশালকে ‘বাংলার ভেনিস’ বলে আখ্যায়িত করে গেছেন। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যটক ইবনে বতুতাও বাংলাদেশ ভ্রমন করতে ভুলেননি। জগৎ শ্রেষ্ঠ এই হাজার মাইল পাযে হেটে ভ্রমণ করেছেন। তাই আসুন প্রিয় বন্ধুরা আমরা আমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আমাদের যোগ্যতাকে সৃজীনশীল করার জন্য, সৃষ্টার প্রতি বিশ্বাসকে মজবুত এবং শক্তিশালী করার জন্য সর্বোপরি সৃষ্টির অপরূপ এ রহস্যকে স্ব-চোখে অবলোকন করার মাধ্যমে মহান স্রষ্টার শোকর আদায় করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন