জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা প্রদর্শনের উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার সিভিল সার্ভিস আইন, ২০১০ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সিভিল সার্ভিস আইনের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার, নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, পদত্যাগ ও অবসর গ্রহণের বিধানসমূহ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এছাড়াও সিভিল সার্ভিসের প্রত্যেক সদস্য আইনানুগভাবে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিভাবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী হবেন, এ সম্পর্কেও উল্লেখ করা হয়েছে । ইতিমধ্যে একটি খসড়া প্রণয়ন করে জনগণের অভিমত যাচাই শুরু হয়েছে, ওয়েবসাইটে প্রচার করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পরামর্শ ও মতামত থাকলে সরাসরি বা ই-মেইলের মাধ্যমে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্যানিং অনুবিভাগের উপসচিবকে যেন অবহিত করা হয়।
জনমত যাচাই করার এ জাতীয় উদ্যোগ প্রশংসনীয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং চিন্তা ও চেতনা থেকে উদ্বুদ্ধ। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের পথে অবশ্যই একটি মাইলফলক। অতীতে সরকারি বিধিবিধান কি হবে জনগণ তা জানবে অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অবহিত হতে পারবে ভাবাই যেত না। পক্ষান্তরে এ জাতীয় কর্মকান্ড গোপনীয় সরকারি দলিল হিসেবে চিহ্নিত থাকাই ছিল নিয়ম। অফিসিয়েল সিক্রেট অ্যাক্ট ১৯২৩-এর ধারক-বাহক বাংলাদেশ। কোন একটি পরিপত্র জারির আগে সংশ্লিষ্টরা জেনে যাওয়া হচ্ছে শৃংখলা ভঙ্গের শামিল, গোপনীয়তা সংরক্ষণের ব্যত্যয়।
সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকালে, যখন প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত, গণমুখী ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে এ জাতীয় একটি আইন প্রবর্তনের কথা বারবার আলোচনায় আসে। বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংঘটিত দুর্নীতি মামলার সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হলে বিষয়টি অধিকভাবে প্রণিধানযোগ্য হয়ে প্রতিভাত হয়। রাজনৈতিক নৈতিকতা বিসর্জন বা পদস্খলনের সঙ্গে আমলাতন্ত্রকে সম্পৃক্ত করলে জনপ্রশাসন বিপর্যস্ত হতে পারে ভেবেই এ জাতীয় আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা জরুরিভাবে অনুভব করা হয়। এছাড়াও জনপ্রশাসনে সংস্কার সাধন, ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা থেকে উত্তরণ, লাল ফিতার দৌরাত্য থেকে জাতিকে মুক্ত করা হচ্ছে বর্তমান পদক্ষেপের মূল ভিত্তি। লক্ষ্য হচ্ছে, জনগণ ও প্রশাসন মিলিতভাবে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অংশগ্রহণ করবে। সরকার সেবামূলক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করবে এ জাতীয় ভাবধারা থেকে মুক্ত হয়ে উন্নয়ন সহযোগীর ভূমিকায় প্রশাসন যন্ত্র অবতীর্ণ হবে এবং তাই হবে একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রের দর্শন। একই সঙ্গে সুশীল সমাজের অভিপ্রায় ও প্রশাসনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকার বর্তমান আইন প্রণয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে ।
এ জাতীয় একটি জনগুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের আগে জনপ্রতিনিধিদের অভিমত, জাতীয় সংসদে বিতর্ক, কর্মশালা ও ওয়েবসাইটে মতামত প্রদানে জনগণের সুযোগ সৃষ্টি হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। সুশীল সমাজ, বিদগ্ধ জনগণ ও বিশেষ অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এবং সরকারি কর্মচারীরাও তাদের অভিমত প্রকাশ করতে পারবে অবাধে ও সুচিন্তিতভাবে। লক্ষ্য হচ্ছে, একটি ভালো আইন প্রণীত হলে সব স্তরের জনগণ স্বস্তিবোধ করবে, তার সুফল পাবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রশাসনের সব স্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক প্রশাসন হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রাথমিক শর্ত এবং একই সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত শক্তিশালী প্রশাসন হবে জাতীয় ও সমাজজীবনে সুবিচার প্রাপ্তির অন্যতম পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত, প্রশিক্ষিত প্রশাসনের প্রয়োজন সর্বাধিক। মূলত, এ চেতনাই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে সিভিল সার্ভিস আইনের প্রতিটি অনুচ্ছেদে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৩ থেকে ১৪০ অনুচ্ছেদে কর্মবিভাগ ও কর্মকমিশনের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে আরও বেশি কিছু সংযোজন করতে হবে বলে অনেকের ধারণা। তবে খসড়া প্রস্তাবনায় বিষয়টি জোরালোভাবে আসেনি, প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়নি যৌক্তিকভাবে। পক্ষান্তরে দুর্বল ভাষা প্রয়োগের ফলে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ নিবারণের বার্তাই বিকশিত হয়েছে বারবার এবং ‘আবশ্যিকতা’ শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহার না হলেও এখানে এসেছে কয়েকবার।
সরকারের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদীয় বিভাগÑ এই তিনটি অঙ্গের মধ্যে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক নিতান্তই নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। নির্বাহী বিভাগের কাছে সুবিচার পেলে বিচার বিভাগের দুয়ারে হাজির হতে হয় না অথবা স্থানীয় সংসদ সদস্যকেও সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয় না। তাই দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন দেশবাসীকে উপহার দেয়া যে কোন গণতান্ত্রিক ও জনপ্রিয় সরকারের মৌলিক দায়িত্ব এবং এর কোন বিকল্প নেই। তাই দিন বদলের সরকার যে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা অভিনন্দনযোগ্য। সংস্থাপন বিভাগ থেকে যে খসড়া সিভিল সার্ভিস আইন, ২০১০ বর্তমানে ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করাই হবে প্রাসঙ্গিক।
প্রথমত, শিরোনাম নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। সিভিল সার্ভেন্ট কথাটি ইংরেজি হলেও অনেকেই এর অর্থ বোঝে। সংক্ষেপে বলা হয়, সরকারি কর্মচারী বা গণকর্মচারী। মেধা ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্তরাই হচ্ছেন সরকারি কর্মচারী। সামরিক বাহিনীর কর্মচারীরা সিভিল সার্ভেন্ট নয়। কিন্তু ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ কথাটি কেমন যেন ইংরেজি বাংলার সংমিশ্রণে শ্রুতিমধুর নয়।
এ আইনটিকে বাংলাদেশ গণকর্মচারী আইন, ২০১০ অথবা বাংলাদেশ জনপ্রশাসন আইন ২০১০ বলা যেতে পারে। গণকর্মচারী বলতে কোন সংশয় থাকার কথা নয়। গণকর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ এবং গণকর্মচারী (অবসর গ্রহণ) আইন ১৯৭৪ এখনও বলবৎ আছে এবং সবার জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (পুনর্গঠন) আদেশ ১৯৮০-এর মধ্যে সার্ভিসসমূহের কথা আছে। এখানেও কথাটি খেয়াল রাখার প্রয়োজন আছে। বর্তমান খসড়ায় কারা সিভিল সার্ভিস নয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন দেশে সিভিল সার্ভিসের ব্যাখ্যা ও পরিধি ভিন্ন। ইংল্যান্ডে রানীর অধীনে নিয়োগপ্রাপ্তরাই হচ্ছে সিভিল সার্ভেন্ট, কাউন্টি বা সিটি কর্পোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্তরা নয়। কানাডাতে সিভিল সার্ভিসের পরিধি বিশাল, প্রায় ২০০ সরকারি দফতর ছাড়াও সব কাউন্সিল, কর্পোরেশন ইত্যাদিতে কর্মরত সবাই সিভিল সার্ভিসের আওতাভুক্ত। চীনের ইতিহাস প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ২২১-২০৭ সালে কিন রাজবংশের আমল থেকেই আমলাতন্ত্রের সূচনা হয়। পরবর্তীকালে হান, সুই, ট্যাং রাজবংশসমূহের আমলে এর প্রসার ঘটে এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিভাবানদের অনুপ্রবেশ ঘটে যার সুফল গণচীন পেয়েছে।
ফ্রান্সে সরকারি ও কর্পোরেশনসমূহে কর্মরত সবাইকে সিভিল সার্ভেন্ট বলা হয়। আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৭২ সাল থেকে সিভিল সার্ভিস প্রথা প্রচলিত আছে। তবে ফেডারেল সিভিল সার্ভিসের পরিধি বিশাল। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, সংসদীয় বিভাগসহ প্রায় সবাই সিভিল সার্ভেন্ট, তবে উর্দিপরা কর্মচারীরা এর বাইরে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে সিভিল সার্ভিস বলতে ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদেরই বোঝায়। পাকিস্তান আমলে সিভিল সার্ভিস বলতে সিএসপিদের প্রতিই দিকনির্দেশনা ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৯টি ক্যাডার আছে, যার মধ্যে ১৫টি সাধারণ, ১৪টি টেকনিক্যাল। বিভিন্ন ক্যাডারের সংখ্যা হ্রাস করার একটি ভাবনা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে এ সম্পর্কে কোন ধরনের ইঙ্গিত বর্তমান খসড়ার নেই। ন্যাশনাল সার্ভিস করার যে কথা সরকার ভাবছে, তার কোন দিকনির্দেশনা এখানে নেই।
দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে দৃষ্টিতে আসছে তা হচ্ছে সপ্তম অধ্যায়ে পদত্যাগ ও অবসর গ্রহণ সম্পর্কে। ২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘অবসর গ্রহণের বয়সসীমা হইবে ৫৮ বৎসর।’ দীর্ঘদিন থেকে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬০ বছর করার দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং শ্রীলংকায় অবসর গ্রহণের সময়সীমা ৬০ বছর। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন ৬৫ বছর। সেখানে ৫৮ বছর করার অর্থ নেই। মূলত এখনও অবসর প্রস্তুতিকালীন সময়সহ ৫৮ বছরই আছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়, বিচার বিভাগ এবং বিআইডিএসসহ অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অবসরের বয়সসীমা হচ্ছে ৬৫ বছর। তাহলে এ আইন সরকারি কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের সুযোগ সম্প্রসারিত করতে পারেনি।
তৃতীয়ত, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কোন সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসর, অপসারণ বা বরখাস্ত করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ ২৫ বছর হলে অবসর প্রদানের যে হাতিয়ার প্রয়োগ করে অতীতে সরকারসমূহ পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল, তা করা সহজ হবে না। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধানের অবসান হবে, এ কথারও উল্লেখ নেই। একই সঙ্গে দলীয় চিন্তায় কাউকে বছরের পর বছর ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে রাখা হবে এবং বেতনভাতা, যানবাহনসহ সব সুযোগ বিনা কাজে দেয়া হবে, এ জাতীয় কোন বিধান রহিত করার কথা উল্লেখ নেই। চতুর্থত, সিভিল সার্ভিসের কাঠামো বিন্যাসে তিনটি স্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সচিব ও অতিরিক্ত সচিবকে (প্রথম ও দ্বিতীয় স্তর) সুপিরিয়র স্তরে ধরা হয়েছে। যুগ্মসচিবদের সিনিয়র স্তরে রাখা হয়েছে। অথচ অনেক মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিবের পদ নেই এবং থাকলেও কার্যবণ্টনে তার ভূমিকা উলেখযোগ্য নয়। পক্ষান্তরে কার্যপ্রণালী বিধিমালা ১৯৯৬ অনুসারে যুগ্মসচিবরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন এবং যুগ্মসচিবরাই সরাসরি সচিবের কাছে নথি পেশ করেন।
একথা সত্য যে, জনপ্রশাসন এবং আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। নিরপেক্ষ, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন জাতির অগ্রগতিতে অমূল্য অবদান রাখতে পারে। এ বিষয়ে কোন ধরনের বিতর্কের অবকাশ নেই। রাজনীতির ধামাধরা বা তোষামোদকারী কর্মকর্তারা গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ, সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য বিপজ্জনক। এ বাস্তবতাকে দৃষ্টিতে রেখে সিভিল সার্ভিস আইনের পরিবর্তন ও সময়োপযোগী করার পদক্ষেপ গ্রহণ হবে একটি মাইলফলক।
- সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন