বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১১

বলদা গার্ডেন -নাজমুল আলম


এমন সবুজ আর সবুজের সমারোহ কোথাও খুঁজে পেলাম না। এ দেশের মাটি ও মানুষের সরলতা, তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা কোনোদিনও ভুলবার নয়। প্রকৃতির এমন আপন করে নেয়া সত্যিই বিস্ময় আমাদের কাছে। বাংলাদেশ ঘুরে বিদায় নেয়ার পথে এমন অনুভূতিই শোনা যায় বিদেশি পর্যটকদের মুখে। লাল-সবুজের পতাকাবেষ্টিত ছোট্ট এ দেশটি যেন প্রকৃতির এক আশ্চার্য রূপ। ষড়ঋতুর এ দেশে বিভিন্ন সময় গড়ে উঠেছে পার্ক, উদ্যান আর স্থাপত্যসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। বলধা গার্ডেন সেগুলোরই একটি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৯০৫ সালে) সাহিত্যমোদী ভাওয়াল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী আপন সৌন্দর্যে গড়ে তোলেন এ উদ্যান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে তিনি নানা রকম ফুল, উদ্ভিদ আর গাছ-গাছড়া এনে রোপণ করেন এ গার্ডেনে। বলধা গার্ডেনকে অভিহিত করা হয় ফুল ও উদ্ভিদের মিউজিয়াম বা যাদুঘর হিসেবে। তবে এখানে গার্ডেন নির্মাণের পূর্বে একটি সত্যিকারের মিউজিয়াম ছিল। তাতে কয়েকটি ধাতব মূর্তিও ছিল। উনিশ শতকের শেষের দিকে (বর্তমান) বলধা গার্ডেন ছিল উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সেখানে প্রতিদিনই গান-বাজনার আসর বসত। এই বলধা গার্ডেনের আদলেই হূষিকেশ নির্মাণ করেছিলেন রোজ গার্ডেন বা গোলাপ বাগান। সেখানে আজ নির্মিত বাড়িটি ছাড়া আর কিছুই নেই। গার্ডেনের দুটি অংশ সিবিলি ও সাইকি। সিবিলি মানে হলো প্রকৃতির দেবী আর সাইকি মানে হলো আত্মা। এ দুটি শব্দ এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। সিবিলি অংশের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে- শঙ্খনদ পুকুর, ক্যামেলিয়া, স্বর্ণ আশোক, আফ্রিকান টিউলিপ। এছাড়া আছে সূর্য ঘড়ি, জয় হাউজ, ফার্ন হাউজ। সূর্যঘড়ি রৌদ্রজ্জ্বোল দিনে সঠিক সময় নির্দেশ করে। সাইকি অংশের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে লাল, নীল, সাদা, হলুদ, জাতের শাপলায় ভরা অনেকগুলো শাপলা হাউজ। বিরল প্রজাতির দেশি বিদেশি ক্যাকটাস, অর্কিড, অ্যানথুরিয়াম, ভুজুপত গাছ, বিচিত্র বকুল, আমাজন লিলি, কৃত্তিম সুড়ঙ্গসহ একটি ছায়া তরু। তবে সাইকি অঞ্চলে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার নেই। সাইকি অঞ্চল শুধু উদ্ভিদের ছাত্র বা গবেষকরা পরিদর্শন করতে পারেন। উদ্যান উদ্ভিদ সম্ভার প্রধানত সাত ধরনের। সব মিলিয়ে এখানে ৬৭২ প্রজাতির প্রায় ১৫ হাজার নমুনা রয়েছে। এদের অনেকগুলো বিদেশি ও দুষ্প্রাপ্য। গার্ডেনের সাথে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। গার্ডেন পরিদর্শনে এসে বহুজাতিক ফুলের সমাহার দেখে কবিগুরু বিস্মিত হন। তিনি জাপান থেকে সংগৃহীত পধসবষরধ লধঢ়ড়হরপধ ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার বিখ্যাত ক্যামেলিয়া কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এছাড়াও বহু বিদেশি ফুলের বাংলায় নামকরণ করেন তিনি। ১৯৪৩ সালে নরেন চৌধুরী মৃত্যুবরণ করলে বাগানের উন্নয়ন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ব্রিটিশ বেনিয়াদের অব্যবস্থাপনায় উদ্যানটি চরমভাবে তিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তান আমলে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। স্বাধীনতার পর বন বিভাগের অধীনে নব উদ্যোমে শুরু হয় এর উন্নয়ন কাজ- বলধা ফিরে পায় তার প্রাণ। এ বলধা গার্ডেনকে ঘিরে আছে এক রক্তাক্ত করুণ ইতিহাস (বর্তমান বলধা গার্ডেনেই ছিল নরেন চৌধুরীর বাসগৃহ)। নরেন চৌধুরীর ছেলে নৃপেণ চৌধুরী স্বীয় প্রতিভায় বন্ধুমহল থেকে সবার কাছে ছিলেন সমাদৃত। ঘরে ছিল তার সৎমা। সৎমার সাথে নৃপেণের তেমন কোনো দ্বদ্ব না থাকলেও তিনি মোটেও সহ্য করতে পারতেন না নৃপেণকে। নৃপেণ প্রতিদিনের মতোই এক রাতে ঘুমাতে যান নিজ গৃহে (বর্তমান বলধা গার্ডেনে)। ছেপে ছোপ রক্ত আর মৃত লাশের ওপর আজও দাঁড়িয়ে আছে চিরসবুজের বলধা। রক্তের উর্বরতায় সেখানে জন্মেছে তাজা গাছ আর বাহারি ফুল। দেশি বিদেশি হাজারো দর্শনার্থীর ভিড়ে বলধা আাজ মুখরিত।
বলধার সাথে আমাদের এ দেশের মিল আছে এক জায়গায়। ৫২ আর ৭১-এর রক্তসাগর আর ভুরি ভুরি লাশের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দেশ। তার মাঝে আবারও জন্ম নেবে শেরেবাংলা, দেশবন্ধু সুভাষ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে উন্নয়ন আর অগ্রগতির পথে। বিশ্বভূমিতে উজ্জ্বল হয়ে ভাসবে তার ছোট মানচিত্র। উড়বে লাল-সবুজের পতাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন