বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১১

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০

একটি শিক্ষানীতির সঙ্গে জাতির ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ জড়িত। এ কারণেই জাতীয় শিানীতি প্রণয়নের সময় ব্যক্তি বিশেষের চিন্তা, বিশ্বাস এবং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে উঠে দেশের মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, কৃষ্টি-সভ্যতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং যুগ চাহিদার প্রতি ল্য রাখা বাঞ্ছনীয়। বর্তমান মহাজোট সরকার মতায় আসার পরপরই কুদরাত-এ-খুদা কমিশন (১৯৭৪) ও শামছুল হক (১৯৯৭) শিানীতির (২০০০) আলোকে একটি নতুন শিানীতির চূড়ান্ত খসড়া ২০০৯ ওয়েবসাইটে প্রদান করে, এ বিষয়ে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। বিভিন্ন মহল সে বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা সামলোচনা করে তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করে। কিন্তু জনগনের প্রদত্ত সে মতামতকে গ্রহন বা বর্জনের কোন সংখ্যাভিত্তিক তথ্য ও ব্যাখ্যা না দিয়ে এর কিছু শব্দ ও টার্ম পরিবর্তন করে শিানীতি ২০১০ চূড়ান্ত করা হয়। আর তা বিগত ৩ অক্টোবর ২০১০ জাতীয় সংসদে পাস করার জন্য বিল আকারে উত্থাপন করা হয়।
শিানীতি একটি দেশের সুনাগরিক তৈরির দিক-নির্দেশনা বিধায় এটা জাতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের বিশ্বায়ন পরিস্তিতি মোকাবেলা করার মত নেতৃত্বদানকারী ,যোগ্য, কর্মমুখী, সুদ, সৎ, আর্দশবান ও প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন করে গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। তাই জাতিকে কাঙ্খিত মানে উন্নীত করার জন্য শিানীতিতে তিনটি বিষয়ে সর্বাদিক গুরুত্বারোপ দেয়া দরকার। তা হল- ১। ধর্ম ও নৈতিক শিা ২। কারিগরী শিা ৩। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিা। শিানীতি ২০১০ এ উক্ত তিনটি বিষয়ে স্বীকৃতি দেয়া হলেও প্রথমোক্ত বিষয়টিকে বাস্তবে উপো করা হয়েছে।
শিানীতি ২০১০ এর প্রাক কথনে দাবি করা হয়েছে “এখানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে”। অথচ বাস্তবতা তা নয়। লণীয় বিষয় হলো , শিানীতি ২০১০ এর কোথাও কোথাও ধর্মশিা ও নৈতিক শিা প্রভৃতি কিছু শব্দ যোগ করা হয়েছে এবং ধর্ম ও নৈতিক শিা নামে একটি অধ্যায় যোগ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত জনগনকে বোঝানো হয়েছে যে, শিানীতি ২০১০ এ ধর্ম শিা রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় প্রাক-প্রাথমিকের শিশু শ্রেণী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত শিার কর্মকৌশলে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ধর্মশিা ব্যবস্থা নেই।
ইতোপূর্বকার কুদরাত-এ-খুদা ও শামসুল হক শিা কমশিনে ধর্ম ও নৈতিক শিা গুরুত্ব না পাওয়ায় বরাবরই এ জাতি সে বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। বর্তমানে প্রনীত ‘শিানীতি ২০১০’ কেও খুদা ও হক কমিশনেরই প্রতিরূপ বলে মনে হয়েছে। এজন্যই এ শিানীতিতে অনেক ভাল
প্রস্তাব থাকার পরেও জাতি তা মেনে নিতে প্রস্তুত বলে মনে হয় না।
চূড়ান্ত খসড়া শিানীতি ২০০৯ এ অধ্যায় ছিল ২৯টি, সংযোজনী ৭টি এবং সরাণি ২টি। তবে শিানীতি ২০১০ এ অধ্যায় আছে ২৮টি। বাদ দেয়া হয়েছে ৫টি সংযোজনী এবং ২টি সারণী। কিন্তু এর কোন কারণ ব্যাখ্যা রাখা হয়নি। এতে প্রতীয়মান হয় যে সংযোজনী ২ ও ৩ বাদ দেয়া হয়েছে জাতিকে শিার বিষয়বস্তু ও ধরন সম্পর্কে সম্পর্ণ অন্ধ রাখার কৌশলে। কারণ এ ২টি সংযোজনীর প্রথমটিতে প্রাথমিক শিাস্তরের জন্য প্রস্তাবিত শিাক্রম কাঠামো এবং দ্বিতীয়টিতে মাধ্যমিক শিা স্তরের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যবিষয় তালিকা ও নম্বর বন্টন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ২০১০ শিানীতিতে বুদ্ধিভিত্তিক এমন কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যাতে পাঠ্যক্রমে কী কী বিষয় আছে, তা জানার কোন উপায় থাকছে না।
পর্যালোচনয়া দেখা গেছে শিানীতি ২০১০ এ কিছু ইতিবাচক দিক অবশ্যই আছে। কিন্তু এতে পবিত্র সংবিধান, জাতিস্বত্তা, জাতীয় বিশ্বাস-মূল্যবোধ ঐতিহ্য-চেতনায় পুরোপুরি প্রতিফলন হয়নি। যেমন-ধর্মনিরপেতাবাদের পরিবর্তে অসাম্প্রদায়িকতা, সহজীবন যাপনের মানসিকতা, সমমৌলিক চিন্তা-চেতরনা গড়ে তোলা, উপজাতিয়দের আদীবাসী বলা, প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর এবং উচ্চতর স্তরের কাঠামো ভেঙে দিয়ে হ-য-র-ব-র-ল করা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সকল ধারায় এক ও অভিন্ন শিাক্রম-পাঠ্যপুস্তক, প্রশ্নপত্র-পরীা মুল্যায়ন-ব্যবস্থা, শিকদের বদলীনীতি, ক্যাডেট ও বিশেষিত শিা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, অন্যান্য েেত্র চরম বৈষম্যনীতি, ইংলিশ মিডিয়াম ও এনজিও শিার্থীদের অনিয়ন্ত্রিত রাখা, মাদরাসা শিায় মৌলিক বিষয় কমিয়ে এনে স্কুলে পরিণত করার কৌশল গ্রহণ, কওমী মাদরাসার প্রতি ঔদাসীনতা, উচ্চ শিায় ব্যাপক বৈষম্য করণ, সংকোচন নীতি এবং ব্যাপক গবেষণার পথ উন্মুক্ত না রাখা, প্রকৌশল-চিকিৎসা-সেবা ও স্বাস্থ্যশিা এবং বিজ্ঞান শিার সংকোচন, তথ্য-প্রযুক্তির নামে আকাশ সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণহীনতা, নারীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা , প্রজনন স্বাস্থ্যশিাাার নামে সংবেদনশীল বিষয় চালুকরণ, চারুকলার নামে নৃত্য-অঙ্গবিপে-যাত্রা-সিনেমা-ব্রতচারী শিা চালুকরণ, প্রতিরা ও সামরিক শিার ব্যাপারে কোন বক্তব্য না দেয়া এবং সুবিধা বঞ্চিত শিশু ও জনগোষ্ঠির শিার ব্যাপারে ঔদাসীন্য, শিাঙ্গনে ছাত্র-শিকদের দলীয় রাজনীতি সম্পর্কে কোন কিছু না বলা, শিকদের সর্বোচ্চ স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদানের ব্যাপারে কোন কিছু না বলা এবং স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদালয় হতে কিছু বিষয়ের বিলুপ্তি ও সংশিষ্ট বিষয়সমূহ স্তর বিন্যাসের ফলে শিকদের চাকরি হারানোর আশংকাসহ আরো অনেক ব্যাপারে এ শিানীতিতে অর্পূণাঙ্গতার ছাপ রয়েছে। কাজেই শিানীতি ২০১০ এর এ সকল অসামঞ্জস্যতা দূর করা প্রয়োজন।
শিানীতি ২০১০ এর একটি বড় ত্র“টি হচ্ছে, এটা একটা দলীয় আদর্শের শিানীতিতে পরিণত হয়েছে। যদিও এটাকে “কোন দলীয় শিানীতি নয়” বলে দাবি করা হয়েছে। উপরোক্ত দলমত ধর্ম নির্বিশেষে জাতির বিভিন্ন শিাবিদ, শিক, শিার্থী, অভিভাবক, রাজনীতিক, আলিম-উলামা, বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় পন্ডিত, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, পেশাজীবীসহ সমাজের সকল স্তরের মতামত, পরামর্শ, সুপারিশ বিবেচনা করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও এ বিষয়ে কোন পরিসংখ্যানগত তথ্য দেয়া হয়নি। অধিকন্তু শিানীতিপ্রণয়ন কমিটিতে যে সকল ব্যক্তিদের নাম উলেখ আছে তারা জাতির সর্বস্তরের গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন বলে মনে হয় না। ফলে শিানীতিতে তাদের চিন্তা-চেতনার যে প্রতিফলন ঘটেছে পুরো জাতির কাছে তা গ্রহনযোগ্য হবে না।
একটি আস্তিক জাতি সত্তার শিানীতি হতে হবে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক গড়ার উপযোগী ধর্মভিত্তিক শিাব্যবস্থা। যেহেতু মানুষ নৈতিক জীব এবং সেই নীতি শেখার মৌলিক ও কার্যকর পন্থা হলো ধর্মশিা। মানুষকে শুধু আইন দিয়ে নয়, বরং ধর্মভিত্তিক নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। তাই সর্বযুগে সর্বকালে মানুষ সভ্য হয়েছে ধর্মভিত্তিক নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে। সকল যুগে সকল দেশের জরিপে প্রমানিত হয়েছে যে, নিষ্ঠাবান ধার্মিক লোকদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা একেবারই থাকে না বা কম থাকে। পান্তরে ধর্মভিত্তিক নৈতিকতাবোধ যাদের মধ্যে যত কম থাকে, সেই জনগোষ্ঠী তত বেশি অপরাধ প্রবণ হয়ে থাকে।
মানুষের মধ্যে সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তি এ দু’ধরনের প্রবৃত্তি বিদ্যমান। সুপ্রবৃত্তিকে কার্যকর করতে হলে কৃপ্রবৃত্তিকে দমন করেই করতে হবে। আর তা একমাত্র সম্ভব সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ভয় ও পরকালীন জবাবদিহীতার মাধ্যমে। সুতরাং শিানীতিতে ধর্মশিাকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে শিার সকল স্তরে বাধ্যতামূলক স্থান দেয়া জরুরী।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ৩৯ বছর যাবৎ সকল সরকারই দূর্নীতিবিরোধী পদপে এবং অপরাধ কমানোর অঙ্গীকার করেছেন, অনেক আইন করেছেন। কিন্তু কোনটাই বাস্তবে কার্যকর হয়নি বরং দূর্নীতি বেড়েছে বহুগুনে। যারা এ প্রবণতা থেকে মুক্ত থেকেছেন তারা মূলত আইনের ভয়ে যতটা নয় তার চেয়ে বেশি তার ধর্মীয় অনুভুতির কারনেই। এর দ্বারা প্রমানিত হয় যে, ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবন ত্র“টিমুক্ত করার একমাত্র গ্যারান্টি হল ধর্মীয় জ্ঞান ও এর অনুশীলন।
শিানীতিতে অবশ্যিই সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে- শিার্থীদের জন্য কোন কোন বিষয় সর্বাগ্রে অবশ্যই জানতে হবে এবং কোন বিষয় ঐচ্ছিক তাও। শিানীতিতে অবশ্যিক জ্ঞান হিসেবে শিশুকে অবশ্যই জানতে হবে-তার স্বীয় সত্তার পরিচায়।এবং তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও স্রষ্টার পরিচয়। অতপর সে জানবে তার মাতা-পিতা, পরিবার-পরিজন ও তার পারিপার্শি¦ক সকল কিছু সম্পর্কে।
এই শিানীতিতে বিভিন্ন অংশে উল্লিখিত কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলো যথাযথ সংজ্ঞায়িত হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় জাতি বিভ্রান্তিতে পড়বে। যথা-দেশজ আবহ, ব্রতচারী, নীতিবোধ, ন্যায়বোধ, সংস্কৃতিমনস্কতা, কর্তব্যবোধ, সংস্কার/কুসংস্কার, শৃঙ্খলা, মুক্তিচেতনা, শিষ্ঠাচারবোধ, সুশিা, সম্প্রদায়িকতা/ অসম্প্রদায়িকতা, কুশিা, মানবাধিকার, আদিবাসী, সহ-জীবন যাপন, সমমৌলিক চিন্তা, নৈতিক/অনৈতিক ও মুক্তবুদ্ধিচর্চা ইত্যাদি।
বাংলাদেশ আদর্শ শিক পরিষদ জাতির এমন একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় তথা শিানীতি ২০১০ এর অধ্যায়ভিত্তিক একটি পর্যালোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো- শিার সাথে সংশিষ্ট মহল এবং দেশবাসীকে শিানীতি ২০১০ এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো অবহিত করা এবং প্রায়োজনীয় মন্তব্য ও পরামর্শ প্রদান করা। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার এ দেশের শতভাগ মানুষের আশা-আখাংকা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবেন এবং শিানীতিটি জাতীয় সংসদে পাস করার পূর্বে গণভোটের ব্যবস্থা করবেন। #
সূত্র: বাংলাদেশ আদর্শ শিক পরিষদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন