মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠ্যত্ব
ফাহিমা নাজনীন
“বিদ্যার ধন না যায় খন্ডন”। বিদ্যা এমনই এক সম্পদ তার কাছে সবকিছুই তুচ্ছ মনে হয়। বিদ্যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ পৃথিবীর বুকে নেই। মানুষ সৃষ্টির সেরা। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা মেধা-বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে তৈরি করেছেন। আর এগুলোকে পরিপূর্ণ করার জন্য জ্ঞানার্জন প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা কাউকে জ্ঞানীরূপে সৃষ্টি করেন নি বরং সকলেই সাধনার মাধ্যমে জ্ঞানী-গুনি হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জ্ঞানকে আরবিতে ইল্ম বলে। এ ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরজ। রাসূল সাঃ বলেছেন সুদূর চীন দেশে গিয়ে হলেও জ্ঞানার্জন কর। আরবদেশ থেকে চীনের দূরত্ব অনেক। একারণে চীন দেশের কথা বলেছেন। এর তাৎপর্য এই যে প্রয়োজনে অনেক দূর দেশে গিয়ে হলেও জ্ঞানার্জন কর।
পৃথিবীতে টাকা-পয়সা, ধন-রতœ, ঐশ্বর্য্য বাড়ি-গাড়ি সব কিছু শেষ হতে পারে, ধ্বংস হতে পারে কিন্তু মানুষের অর্জিত জ্ঞান কখনো ধ্বংস হয় না বা শেষ হয় না। জ্ঞানের যত বেশী দান তত বেশী বৃদ্ধি। জ্ঞানার্জনের শেষ নেই। জ্ঞানার্জনের পরিধি বিস্তৃত মৃত্যু পর্যন্ত। রাসূর সাঃ বলেছেন- তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন কর। ইহ-পরকালীন জীবনে মুক্তি ও সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হতে হলে জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। জ্ঞানার্জন দু’ধরনের হতে পারে। পার্থিব অর্থ্যাৎ দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করার জন্য। আরেকটি হচ্ছে ধর্মীয় অর্থ্যাৎ পরকালীন জীবন পরিচালনা করার জন্য। আর দুনিয়াই হচ্ছে আখেরাতের শষ্যতে। দুনিয়াতে আখেরাতের বীজ বপন করতে হবে আর তার ফসল আখেরাতেই পাবো। দুনিয়াতে যেভাবে যে বীজ বপন করি না কেন তার ফল পরকালে ভোগ করতে হবে। এেেত্র জানার বিকল্প নেই। দুনিয়ার জীবনকে যদি চিরস্থায়ী পরকালীন জীবনের জন্য ব্যয় করতে না পারি তাহলে এ মিছে মায়ার সৌন্দর্য্য মন্ডিত পৃথিবীর লোভ লালসার মোহ-মত্তায় বেচে থাকার সাধ ব্যর্থতায় পর্যবসিত। এ পৃথিবীতে মানুষ বেচেঁ থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে। খুব ব্যস্ততার সাথে দুনিয়ায় বেচে থাকার প্রচেষ্টা চলে কিন্তু এ বেচে থাকার উদ্দেশ্য কি? একমাত্র মহান আল্লাহর হুকুম আহকাম মেনে বিশুদ্ধ ভাবে তার ইবাদত করা। বিশুদ্ধ ভাবে ইবাদত করতে ও আল্লাহর বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করতে হলে সর্বাগ্রে জ্ঞান অর্জন সাধনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হবে। অর্থাৎ জ্ঞানার্র্জনের জন্য সাধনা করতে হবে। যে যত বেশী জ্ঞানর্জন করবে সে আল্লাহ ও তার বান্দার উভয়ের নিকটই সম্মানিত হবে। সে ইহ কালীন কল্যাণ ও পর-কালীন মুক্তি উভয়টি অর্জন করল। বিজ্ঞ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেছেন যে, আলিম অর্থাৎ জ্ঞানী মুমিনের মর্যাদা সাধারণ মুমিনদের অপো সাতস্তর বেশী। আর এক স্তর থেকে আরেক স্তরের দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথ। যার ভিতর কোরআন ও হাদীসের জ্ঞান আছে সেই আলিম।
রাসূল (সা:) বলেছেন-আমার যে উম্মত চল্লিশটি হাদীস মুখস্ত অর্থাৎ স্মরণ করে রাখে, রোজ কিয়ামতে সে আল্লাহর সাথে ধর্মজ্ঞানী ও আলিম হিসেবে সাাত করবে। আল্লাহ তায়ালা জ্ঞানী আলিমদের পদ মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন। [ইলম অর্থ জ্ঞান; ইলম থেকে আলিম শব্দটি নেয়া হয়েছে এর অর্থ জ্ঞানীগণ]। আলিমগণ অর্থাৎ জ্ঞানীগণ কখনো মুর্খের তুল্য হতে পারে না। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- হে নবী (সা:) আপনি বলুন, আলিম বা জ্ঞানীজন কি কখনো অজ্ঞান তথা মুর্খ লোকের সমান হতে পারে?
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন- বান্দাদের মধ্যে কেবল আলিমগণই আল্লাহকে বেশী ভয় করে। সমগ্র বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে আল কুরআন। যা সব কিছুর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম। সব কিছুর সুষ্ঠু সমাধান ও সুষ্ঠু পন্থা এ মহামান্বিত পবিত্র গ্রন্থে সূচারুরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। যে ব্যক্তির মাঝে এ মহাগ্রন্থের জ্ঞান আছে সে কখনো বিপদগামী হয় না। তার মাঝে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। যিনি দিনরাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করে তার মাঝে ও আলিমের মাঝে নবূয়ত সমতুল্য পার্থক্য।
মহানবী সা: ইরশাদ করেন আবেদের উপর জ্ঞানীর শ্রেষ্ঠত্ব ঠিক একজন সাধারণ সাহাবীর উপর আমার শ্রেষ্ঠত্বের অনুরূপ। এ হাদীসটি সকলেরই অনুধাবন যোগ্য যে, মহানবী সা: কিভাবে ধর্মীয় জ্ঞানকে নবুয়াত সমতুল্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন এবং জ্ঞানহীন আমলের মূল্য কত নগন্য দেখিয়েছেন।
হযরত আবু দাউদ (আ:) এর পুত্রে হযরত সুলাইমান (আ:) কে ইলম, ধন-সম্পদ এবং বাদশাহী এ তিনটি বস্তুর যেকোন একটিকে পছন্দ করে নিতে বলা হয়েছিল। তিনি ইলমকে পছন্দ করে নিয়েছিলেন। যার ফলে তাঁকে ইলমের সাথে ধন-সম্পদ এবং বাদশাহী ও দান করা হয়েছিল।
শেরে খোদা হযরত আলী (রা:) কুমাইলকে বলেছিলো কুমাইল। ইলম ধন-রতেœর চেয়ে উত্তম। ইলম বা জ্ঞান তোমার নিরাপত্তা প্রহরী আর তুমি ধন-রতœ রার প্রহরী ইলম হচ্ছে-শাসক এবং ধন-রতœ শাসনাধীন। ধনরতœ ব্যয়ে হ্রাস পায় কিন্তু ইলম ব্যয়ে হ্রাস পায় না বরং বর্ধিত হয়।
হযরত আলী (রা:) আরো বলেছেন আলিম রোযাদার, রাত্রি জাগারণকারী নামাযী এবং ধর্ম যোদ্ধা থেকে উত্তম। আলিমের প্রাণ বিয়োগ ঘটলে ইসলামের বিপদাপন্ন হয়।
আবুল আস ওয়াদ (রহ:) বলেছেন-“জ্ঞান অপো অধিক সম্মানিত বস্তু দ্বিতীয়টি নেই”। যার মধ্যে পার্থিব ও ধর্মীয় জ্ঞান আছে সে ভালো ও মন্দ উভয় পথের অবস্থা জানে ও উপলদ্বি করে। আর আল্লাহও তাকে পছন্দ করেন এবং ইহ-পরকালীন ঊভয় জগতে সম্মানের মর্যাদার অধিকারী হন। মানুষ আর চতুষ্পদ জন্তুতে যে বস্তু পার্থক্য সৃষ্টি করে তাহলো জ্ঞান। মানুষ তো তখনই মানুষ রূপে বিবেচিত হবে যখন তার মধ্যে মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও গুনাগুন বর্তমান থাকবে। আর মানুষ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ জাতি, সৃষ্টির সেরা, তার মধ্যে সৃষ্টির গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণ পাওয়া যাবে।
মানুষের মর্যাদা তার দৈহিক শক্তির কারণে নয়, কেননা উষ্ট্র মানুষের চেয়ে অধিক শক্তিশালী।
মানুষের মর্যাদা তার বিশাল দেহের কারণে নয়, কেননা হাতীর দেহ তার থেকে বহুগুনে বিশাল ও বিরাট।
মানুষের মর্যাদা তার বীরত্বের কারণে নয়, কেননা ব্যঘ্র, সিংহ প্রভৃতি হিংস্র জন্তুর বীরত্ব তাঁর অপো অনেক বেশী।
মানুষের মর্যাদা তার খুব বেশী আহার করার জন্যও নয়, কেননা ষাঢ়ের উদর মানব উদর থেকে অনেক বড়।
তবে প্রশ্ন আসে কিসে মানুষের মর্যাদা? মানুষের মর্যাদা, গৌরব এবং শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তার বিদ্যা ও বুদ্ধি এবং মানবোচিত জ্ঞানের কারণে।
- শিক্ষিকা, দণি কাঠালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গলাচিপা, পটুয়াখালী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন