অপরাধের বিস্তার ও নারী নির্যাতন
শাহ আবদুল হান্নান
কয়েক দিন আগে পত্রিকার খবরে দেখা গেছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে প্রায় দুই হাজার মানুষ খুন হয়েছে এবং দেড় হাজারের মতো ধর্ষণের ঘটনাঘটেছে। অন্য এক খবরে দেখা যায়, পুলিশ উঠতি মাস্তানদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্য দিকে আইজিপি খন্দকারহাসান মাহমুদ ১০ অক্টোবর বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। একই কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও বারবার বলেছেন। সাধারণ লোকেরাকিন্তু এই কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।
এ পরিপ্রেেিত আমার মনে হয়, জাতি এক ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে আছে। এটা বৃদ্ধি পাবে, যদি এখনই মোকাবেলার উদ্যোগ না নেয়া হয়। উঠতি মাস্তানদেরকথা দিয়েই শুরু করি। কেন পাড়ায় পাড়ায় এসব মাস্তানের আবির্ভাব ঘটছে? কেন বস্তিগুলো থেকে বিপুলসংখ্যক মাস্তান, খুনি, ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও মাদকব্যবসায়ীর উদ্ভব ঘটছে? এর কারণ বোধহয় সবারই জানা। বস্তিগুলোতে সত্যিকারের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। সেখানে না আছে পানির ভালো ব্যবস্থা, নাআছে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট। শিার সুযোগ তো একেবারেই নেই। বস্তিবাসী মা-বাবার সন্তানরা শিা পাচ্ছে না। অথচ শিা লাভ করা ছাড়া এদের কর্মসংস্থানসম্ভব নয়। তা হলে এরা ভবিষ্যতে কী হতে পারে? তারা হতে পারে এবং হচ্ছেও ছিনতাইকারী, পকেটমার, মাদকসেবী, মাদক বিক্রেতা, ভাড়াটে খুনি, ধর্ষণকারী ইত্যাদি।
মাস্তানদের মধ্যে ধনী পরিবারের কিছু সন্তানও আছে। অথচ তাদের কোনো অভাব নেই। তাদের নিজেদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। তার পরও তারা মাস্তান, ধর্ষণকারী, ছিনতাইকারী হচ্ছে। এদের ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। এরা পরিবারে ভালো শিা ও নৈতিকতা পায়নি। বাবা-মায়ের খবরদারি তাদের ওপর অধিকাংশত্র থাকে না। তারা ইন্টারনেট থেকে অশ্লীলতা শিখছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের েেত্র তাদের ওপর বাসায় বাবা-মা নজর রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। ভিডিওতেনানা ধরনের যৌনতা দেখে তারা ভয়াবহ যৌনকাতর হয়ে পড়েছে। এদের পে অন্য নারীর মর্যাদাহানি কোনো ব্যাপার নয়। ইভটিজিং বা কিশোরীদের বিরক্তকরা তাদের জন্য কোনো বড় ব্যাপার নয়। তারা সহজেই ধর্ষণকারীতে পরিণত হয়। এমনকি তারা ধর্ষণের সংখ্যার হিসাব পর্যন্ত রাখে। যে যত বেশি ধর্ষণকরেছে, তাদের গোষ্ঠীর কাছে তারা বড় বীর। েে
এ পরিস্থিতিতে আমাদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চিন্তা করতে হবে। শহরের বস্তিগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যেসব বস্তি উঠিয়ে দেয়া সম্ভব, উঠিয়ে দিতে হবে। বস্তিবাসীকে নিজ গ্রামে ফেরত পাঠাতে হবে। তাদের পুনর্বাসনে কাজে লাগাতে হবে কিছু এনজিওকে। বস্তির মালিকদের বাধ্য করতে হবেযেন তাদের মালিকানাধীন বস্তিগুলোতে পানি ও টয়লেটের সুব্যবস্থা থাকে। খাসজমির বস্তিগুলোতে এসব ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনকে করতে হবে। ঢাকার কথাবলছি। অন্য প্রধান শহরগুলোতেও একই ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেক বস্তিতে শিার উদ্যোগ নিতে হবে। কিছু এনজিও’র সহায়তায় প্রত্যেক বস্তিতে বাকয়েকটি বস্তিকে ভিত্তি করে প্রাইমারি এবং বৃত্তিমূলক শিার ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজন। তারা যাতে কাজে যায়, সেজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। যত দিন কাজনা পাবে, এদের বেকার ভাতা দেয়া দরকার। শিা ও কাজ না দিয়ে বাস্তবে মাস্তানি থেকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়।
অবশ্যই পুলিশের ভূমিকা অনেক বড়। মাস্তানি দমনে তাদের প্রচেষ্টা অবশ্যই চালাতে হবে। বিশেষ করে বড়লোকের সন্তান, অনেক েেত্র শিতি মাস্তানদেরব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। পুলিশ কর্তৃপ স্বয়ং তাদের সংযোগ প্রোগ্রামের আওতায় বিভিন্ন বস্তিতে স্কুল ও কিনিক প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং করাউচিত। বর্তমান আইজিপি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারেন।
এখন নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সব ধরনের নারী নির্যাতনই বাড়ছে; যৌতুক সংক্রান্ত অপরাধ, এসিড নিপে, অপহরণও জোর করে বিবাহ ইত্যাদি। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে ধর্ষণ এবং ধর্ষণপূর্বক হত্যা। আমরা এ ব্যাপারে যথাযথ কৌশল (স্ট্র্যাটেজি) নির্ধারণ করতেপারছি না। এর কারণ, ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে চিন্তাভাবনা এবং টিভি চ্যানেল ও বিজ্ঞাপনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে অনীহা। এদের বাদ রাখাহলে কোনো কৌশলই কাজ করবে না। আইন প্রোয়াজন (তা আছেও)। পুলিশি তৎপরতা ও আইন প্রয়োগ, মানসিক চিকিৎসা, মাদকসেবীদের পুনর্বাসন, অপরাধী যুবকদের কাজ দেয়া ও পুনর্বাসন সবই প্রয়োজন। এতে আমার বা সম্ভবত কারো ভিন্ন মত নেই। কিন্তু আমি মনে করি, যদি শিাব্যবস্থা মাধ্যমেনৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ পুনর্বহাল করা না যায়, টিভি চ্যানেলে যদি নৈতিকতাবিরোধী অনুষ্ঠান-নাটক ইত্যাদি চলতেই থাকে, উপস্থাপিকারা যদি উগ্রপোশাক পরিধানের রেওয়াজ সৃষ্টি করেন, বিজ্ঞাপন যদি যৌন-উদ্দীপক হয় এবং কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকে, পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়াহয়, তাহলে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ কমানো কঠিন হবে। সত্যি বলতে কী, যখন বস্তি ও রাস্তায় মানুষ ও কিশোরদের (ঝঃৎববঃ ঈযরষফৎবহ) দেখি, তখনতাদের মধ্যে যাদের বয়স ১২ বা ১৩ বছর বা বেশি, এদের কাছে কোনো নারীই নিরাপদ মনে হয় না। তারা নারীদের যেকোনোভাবে নির্যাতন করতে পারেবলে আশঙ্কা হয়। উঠতি ধনী মাস্তানদের সম্পর্কে একই রকম মনে হচ্ছে। প্রশাসন ও দেশবাসীকে বলছি, অবিলম্বে এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা না করলে এসঙ্কট থেকে জাতির মুক্তির কোনো উপায় দেখি না।
লেখক ঃ সাবেক সচিব,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন