শুক্রবার, ৩ জুন, ২০১১

কবি


জাতীয়
কবি
কাজী
নজরুল
ইসলাম
মু: সাইফুল

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন তাকে জাতীয় কবি বলা হয় কেন। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে, জাতীয় কবিতিনিই হতে পারেন যার কাছে জাতির আশা আকাঙ্কা, স্বপ্ন কল্পনা, সংগ্রাম সাধনা  ইতিহাস ঐতিহ্য, এবং সামগ্রিক আত্মপরিচয় বিধৃত। জাতীয় কবি তিনিইহতে পারেন যার কাজ শুধু জাতীয় সাহিত্যের ভান্ডারই সমৃদ্ধ করে না, দেশের মাটি, মাানুষ, প্রকৃতি এবং দেশ বাসীর আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন, কল্পনা, সংগ্রামসাধনার রূপায়ন ঘটায় ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আত্মপরিচয় স্বতন্ত্র নির্বিশেষে সবার পরিচয় বিধৃত করে। জাতীয় কবি তিনিই হতে পারেন যার কাজসমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে যেমন বাংলার মুসলিম সমাজকে জাগিয়েছেন। অপরদিকে তেমনি সমগ্র বাঙালী জাতিকেমুক্তির বাণী শুনিয়েছেন। তার কবিতা   গানের চরিত্রে বঞ্চিত শোষিত নিপীড়িত মানুষের কথা বলে, যা সারা দুনিয়ার মজলুমের বাণী হয়ে উঠেছে।সেকালের শাসক শোষক শ্রেণী, কবি কন্ঠের সে আওয়াজ উপলদ্ধি করেই তার একাধিক গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত এবং তাকে কারারুদ্ধ করেছিল। নজরুল ইসলাম বিদ্রোহীকবি। মুসলমানদের পরাজিত করে ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা মতা দখলের পর ১৮৫৭ সালে দীর্ঘ ১০০ বছর পর ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ হয়। ১৮৯৯সালে কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীরঅনল প্রবাহকাব্যগ্রন্থ রচনা ১৯০২ সালে প্রকাশের পর ব্রিটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার করে। দীর্ঘ ১৪৪বছরের মধ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এটি দ্বিতীয় প্রতিবাদ। অথচ ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহন করেন এবং এরই মধ্যে তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ লিখে বিখ্যাতহয়ে উঠেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ এবং ১৯০২ সালে ইসমাইল হোসেন সিরাজীর কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত গ্রেফতারে তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।১৯০৬ সালে স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ গঠিত হলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সফল হয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ কলকাতা  কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরাবঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও তারা বিরোধিতা করেন। ইতিমধ্যেই ব্রিটিশদের আক্রমণ করে নজরুলের কিছুকবিতা লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে। ১৯২২ সালে বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে নজরুলের আসল চেহারা ফুটে উঠে। এই বিদ্রোহী কবিতারমাধ্যমে ১৭৫৭ সালের পর তৃতীয়বারের মত সিপাহী বিপ্লব হয়। বিদ্রোহী কবিতার বিদ্রোহ ছাড়া আর কোন বিদ্রোহের কথা ইতিহাসে জানা যায় না। দ্বিতীয়তকাজী নজরুল কে শুধুমাত্র বিদ্রোহী  কবি আখ্যায়িত করলে খন্ডিত করে দেখা হয়। তিনি মূলত মানবতার কবি। ইব্রাহীম খাঁ কে লেখা একটি পত্রে তিনি বলেনআমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। স্রষ্টাকে আমি দেখিনি কিন্তু মানুষকে দেখেছি। এই ধুলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণকরবে এই ধূলোর নিচে স্বর্গ টেনে আনবে আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি। সব ব্যথিতের ব্যথায় সব অসহায়ের অশ্রজলে আমি আমাকে অনুভব করি, আমারপ্রতিচ্ছবি দেখতে পাই মানুষ কবিতায় তার দৃপ্ত উচ্চারণ-
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নহে
নহে কিছু মহীয়ান।
কবি শ্রমিকের গান, কৃষাণের গান, ধীবরের গান, চাষী গরীবের ব্যথা ফরিয়াদ কবিতায় চিরবঞ্চিত গণমানুষের কথা বলেছেন। তার মানুষ দেশ কালেরঊর্ধ্বে শ্রমজীবী
সাধারন মানুষ- আর অর্থে তিনি বিশ্বমানবতার কবি।
তৃতীয়ত, নজরুল  ছিলেন অসম্প্রদায়িক কবি। শাস্ত্রধর্ম অপো মানুষ্য ধর্ম তার কাছে বড় ছিল। সাম্যবাদী কবিতায় তার সাহসী উচ্চারণ এই হৃদয়ের চেয়ে বড়কোন মন্দির কাবা নাই। তিনি কোন ধর্মের বাছ বিচার করেন নি। তিনিই বলতে পেরেছিলেন-
হিন্দু না ওরা মুসলিম জিজ্ঞাসে কোন জন
কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার
চতুর্থত হিন্দু মুসলমানের সংস্কৃতি যেভাবে নজরুল আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন অন্য কোন কবি সে ভাবে আয়ত্ব করতে পারেননি। তিনি একই সঙ্গে  শ্যাম সঙ্গীত হামদ-নাত রচনা করেছেন। হিন্দুদের নিয়ে রক্তাম্বরধারিণী মা, আনন্দময়ীর আগমনে প্রভৃতি কবিতা লিখেছেন। ইসলামের বিষয় নিয়ে ফতেহা-ইয়াজদহম, কোরবানী, মহররম প্রভৃতি কবিতা রচনা করেন। ১৯২৮ সালে কলকাতায় তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। সভার নেতা সুভাষচন্দ্র বসুঅকপটে উচ্চারণ করেন, আমরা যখন যুদ্ধ েেত্র যাব তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। সভাপতির ভাষনে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন, নজরুলইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশদররা এক একটি অতি মানুষে পরিনত হবে। রবীন্দ্রনাথও অন্য এক প্রসঙ্গে নজরুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কেবলেন জনপ্রিয়তা কাব্য বিচারের স্থায়ী নিরিখ নয় কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে তা শুধু নয় মহাকাব্য।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হল যে রকম একজন মহান কবিকে আজ এদেশেই তার প্রাপ্ত সম্মান টুকুও দেয়া হচ্ছে না। আরো দুঃখের বিষয় এই যে কাজীনজরুল ইসলামকেই নয় বাংলা সাহিত্যে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কায়কোবাদ, জসীমউদ্দিন, গোলামমোস্তফার নাম ভুলক্রমেও উচ্চারিত হয় না কোন সভাসমিতিতে অথচ একশ্রেণীর মিডিয়া বর্তমান সময়ে জানা-অজানা, চেনা-অচেনা কত কবি সাহিত্যিক শিল্পী গুণীজন বলে বিবেচ্য মানুষকে সংবর্ধনা, পদক, সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। আর প্রিন্ট মিডিয়া ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচার করছে। আরবেশী কথা বলতে চাই না। তবে অনেক  মানুষ প্রশ্ন করেন যে এত বড় একজন কবি কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন না? অনেকে আবার উত্তর দেন যে নজরুলেরকবিতা ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়নি এই জন্য পাননি। মজার বিষয় হল সময় ইংরেজরা খুব ভাল বাংলা জানত না। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে কোনকবিতা বা বিছু লেখা হলে পরদিনই তা বাজেয়াপ্ত  করা হতো। অনুবাদ না করে  কিভাবে সেটা বুঝতে পারতো ইংরেজ বুদ্ধিজীবীরা আরেকটা বিষয় হচ্ছে কবিনজরুলের কবিতা যে হারে এবং যত তাড়াতাড়ি ইংরেজীতে অনুবাদ হতো অন্য কোন কবির  কবিতা এত দ্রুত  হতো না। তাহলে কেন তিনি নোবেল পেলেননাবিবেকবানদের  প্রশ্ন, কারণ তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অন্য সকল কবিদের মত ব্রিটিশদের আস্থাভাজন ছিলেন না। তিনি নিপীড়িত মজলুম মানুষেরপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে  সমোঝতা নয়, বিদ্রোহ করেছিলেন।  যারা ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্টপোষকতায় সাহিত্য রচনা করেছেন তারা নানাপদক সম্মাননা  এমনকি তাদের নামে বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠান নামকরণ করার কথা বলা হয়েছে। অথচ যারা জেল খেটে সীমাহীন অত্যাচারের স্বীকার করেদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য কবিতা লিখেছেন সেই সকল কবিদের আজ কোন নাম , আলোচনা নাই, সম্মান নাই ১৯৭২ সালে শেখমজিবুর রহমান নজরুলকে দেশে নিয়ে এসেছিলেন। তখন কিছু দিন তার উত্তম পরিবেশ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল বর্তমানে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীএকজনকে বড় করতে গিয়ে কবি নজরুলের মত কবিকে সাধারন কবিদের সাথে শামিল করতে চান। তাই নজরুলকে নিয়ে আরো গবেষণা আলোচনারদরকার। অবশ্য ২৫ মে তার জন্মবার্ষিকী পালন উপল্েয আলোচনা চলছে এবং আরো আলোচনা হবে , কিন্তু সরকারী ব্যাপক পৃষ্টপোষকতায় আরো গবেষণা আলোচনা প্রয়োজন।

লেখক : শিার্থী, বাংলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন