মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০১১
সুদের ভয়াবহতা ও আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থা - ফারজানা হামিদ
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে সুদ বুঝানোর জন্য যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তার নাম হলো রিবা। রিবা শব্দটির অর্থ হলো অতিরিক্ত, বেশি, বৃদ্ধি, বিকাশ। অর্থাৎ রিবা হচ্ছে সেই বাড়তি অর্থ যা ঋণদাতা পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিয়ে তারই বিনিময় হিসাবে ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে আদায় করে থাকে। রিবা হচ্ছে সেই বাড়তি অর্থ যা কোন মালের বিনিময় নয়। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই সুদী ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। সুদ সম্পর্কে তারা যথেষ্ট জ্ঞাত নয়। তাদের কাছে সুদ একটি সাধারণ বিষয়। বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকিং ধারায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেনদেন করার ফলে তারা যে সুদের সাথে প্রত্য ও পরো ভাবে জড়িত হচ্ছে এ সম্পর্কে তারা সচেতনতা বোধ করেনা। কিভাবে সম্পদকে বৃদ্ধি করা যায় এটাই তাদের প্রধান নেশা, এর বিনিময়ে যে কি ভয়াবহতা তাদের জীবনকে ধ্বংস করে দেয় তা তারা আচঁ করতে পারেনা। অনেক েেত্রই লোক মুখে শোনা যায় যে, ইসলামী ব্যাংক গুলো সুদ খায় তবে ঘুরিয়ে খায়, সোজাসুজি খায় না। আবার এ কথাও শোনা যায় যে, ইসলামী ব্যাংক গুলো সুদ খায় তবে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় কম খায়। এ কথাগুলোর আসলেই কোন ভিত্তি নেই। আমার মতে তাদের এ ধারণা নিছক অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা তারা না বুঝেই এ ধরণের কথাবার্তা বলে থাকেন। বাহ্যিক দিক থেকে উভয় ব্যাংকের কার্যাবলী একই মনে হলেও মূলত এক নয়। এই বিষয়টা বুঝতে হলে দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে এ বিষয়টি ধারণা পরিষ্কার করা যেতে পারে। যেমন কোন গরু জবেহের সময় ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ নিয়ে জবেহ করা আর ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ না নিয়ে জবেহ করা এক বিষয় নয়। যদিও বাহ্যিক দিক থেকে উভয়ই গরু জবেহের ধরণ,জবেহের উপকরণ তথা ছুরি, রশি ইত্যাদি একই ধরণের হলেও তবুও উভয় গরুর মধ্যে ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ নিয়ে জবেহ করার কারনে একটি হালাল আর ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ না নিয়ে জবেহ করার কারণে অন্যটি হারামে পরিণত হয়।
এমনিভাবে বাহ্যিক দিক থেকে ইসলামী ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা একই মনে হলেও সূক্ষ্ম পার্থক্যের কারণে উভয়ের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। যেখানে প্রচলিত ব্যাংকগুলো ডিপোজিট সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট শতকরা হারে, সেখানে ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে চুক্তি করে যে, ব্যাংক তাদের অর্থ ব্যবসায় খাটিয়ে যে লাভ বা মুনাফা হবে তা থেকে তাদেরকে পূর্ব চুক্তি মোতাবেক একটি শতকরা হারে এই মুনাফা প্রদান করবে। আর লোকসান হলে পূর্বচুক্তি মোতাবেকই গ্রাহকগণ তা বহন করবে। ‘বিসমিল্লাহ অথবা আল্লাহর নাম’ এখানে চুক্তির শর্তের কারণেই ইসলামী ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। আর এ চুক্তির শর্তগুলো যারা বুঝতে চায় না বা বুঝে না তারাই উপরোক্ত ঐ ধরণের নানা কথাবার্তা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলে। সুদ এমন একটি ফাঁদ যে ফাঁদে আটকে কেবল মানুষ মৃত্যুর মাধ্যমেই ধ্বংস হয়ে যায় না। বরং অনন্ত কালের জন্য চরম দশায় নিপতিত হয়ে ধুকে ধুকে জ্বলতে থাকবে অথচ সে যন্ত্রণা কিছুমাত্র শেষ হবে না। সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জীবনের তিনটি পর্যায়ে সুদের ভয়াবহতা আঁচ করতে পারে। সুদ মানুয়ের তিনটি বিষয়ের উপর আঘাত হানে।
প্রথমত মানুষের ইমানদারীতায়, দ্বিতীয়ত পরকালীন মুক্তির বিষয়ে, তৃতীয়ত মানুষের ইহকালীন অর্থনৈতিক মুক্তির উপর। অর্থাৎ সুদের কারণে সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার অন্যতম মৌলিক পরিচয় ইমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন হতে বঞ্চিত হয়। পরকালীন জীবনে আল্লাহর অপূর্ব নিয়ামত জান্নাত লাভের পরিবর্তে জাহান্নামে নিপতিত হওয়াকে নিশ্চিত করে। এবং যে দুনিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তথা সুখ-শান্তি হতে বঞ্চিত হয়। অর্থাৎ তার সব কূলই বৃথা। আমরা যদি সুদ মুক্ত হয়ে থাকতে পারি তবেই আমাদের জীবন হবে স্বার্থক । এছাড়া আমাদেরকে কঠোর আযাবের সম্মুখীন হতে হবে। সুদ সম্পর্কে কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত -
“যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা জ্ঞানশূণ্য করে দিয়েছে। এই জন্য যে তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। যার কাছে রবের এ নিদের্শ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা আবার আরাম্ভ করবে তারাই জাহান্নামী। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।” (সুরা বাকারা ঃ ২৭৫)
মানুষের ধনসম্পদ বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা যে সুদ দিয়ে থাকো তা আল্লাহর দৃষ্টিতে ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে না। কিন্তু যে যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য দিয়ে থাকো তাই বৃদ্ধি পায়; তারাই সমৃদ্ধিশালী। (সূরা ঃ রুম ৩৯)
হে ইমানদারগণ তোমরা এই চক্রবৃদ্ধি সুদ খেয়ো না এবং আল্লাকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (আল ইমরান ১৩০)
আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ণ করবেন এবং দান কে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। (সূরা বাকারা ২৭৬)। যদি তোমরা সুদের ব্যবসা না ছাড়ো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধেও জন্য প্রস্তুত হও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা অত্যাচার করবে না এবং অত্যাচারিতও হবে না। (সূরা বাকরা ২৭৯)
উপোরক্ত আয়াতগুলো হতে আমরা বুঝতে পারি, যারা পরকালকে অস্বীকার করে বা মিথ্যা মনে করে কেবলমাত্র তারাই সুদী ব্যবসায়ে অর্ন্তভূক্ত হয়ে আল্লাহর বিধান লঙ্গন করতে পারে। যেখানে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুদ সম্পর্কে এত আয়াত নাযিল করেছেন। যেন আমরা কোনভাবেই সুদী ব্যবসায়ে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে না পারি। যদি মান্য না করি তাহলে তো আল্লাহর অস্তিত্বকেই অবিশ্বাস করা হল। আর যারা এরপরেও সুদীকারবারীরা তারা নিশ্চিত জাহান্নামী হবে এবং সেখানে চিরকাল থাকবে। মহান আল্লাহ এ বিষয়ে এমন কোন সুযোগ রাখেননি যে,সুদ খেলে তাকে কিছুটা রেহাই দেয়া যাবে। বরং তার জাহান্নামী হওয়ার বিষয়টা নিশ্চিতরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। জাহান্নাম একটা অদৃশ্য বিষয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কালামে জাহান্নামের চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন।
তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছে তাদের অচিরেই আমি জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে দেব, অতপর (পুড়ে যখন) তাদের দেহের চামড়া গলে যাবে তখন আমি তার বদলে নতুন চামড়া বানিয়ে দেবো যাতে করে তারা আযাব ভোগ করতে পারে। (সূরা নিসা ৫৬)
রাসূল (সা:) সুদখোরদের বিষয়ে বলেছেন- সামুর ইবনে জুনদুব (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন নবী (সা) বলেছেন আজ রাতে আমি স্বপ্নে দু’জন লোককে দেখলাম। তারা আমার নিকট এসে আমাকে নিয়ে একটি পবিত্র ভূমিতে গেল। আমরা চলতে চলতে একটি রক্ত নদীর তীরে পৌছে গেলাম। নদীর মধ্যখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আর নদীর তীরে একটি লোক দাঁড়িয়ে ছিল যার সামনে ছিল কিছু পাথর এরপর নদীর মাঝে দাঁড়নো ব্যক্তি। তীরের দিকে অগ্রসর হলে তীরে দাঁড়ানো লোকটি তার মুুখমন্ডল ল্য করে পাথর নিপে করল এবং সে আগে যেখানে ছিল সেখানেই উঠে আসার চেষ্টা করছে তখন তীরের লোকটি তার মুখ ল্য করে পাথর ছুড়ে মারছে। যার ফলে সে (পূর্বাবস্থায়) ফিরে যাচ্ছে। নবী (সা:) বলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম এ লোকটি কে? কী কারণে তার এ শাস্তি হচেছ। তারা (আমার সাথের লোক দু’জন) বললো, নদীর মধ্যে দাঁড়নো যে লোকটি দেখলেন, সে একজন সুদখোর।
প্রকৃত পে আমরা যে সম্পদ গড়ে যাচ্ছি এর কোন কিছুই আমাদের সাথে যাবে না।
রাসূল (সা:) বলেছেন তিনটি সম্পদ তোমাদের নিজেদের।
এক. যা তোমরা খেয়েছ। দুই. যা তোমরা পরিধান করেছ। তিন. যা তোমরা আল্লাহর রাস্তায় দান করেছ।
তবে আমরা কেন সুদের মাধ্যমে এত এত সম্পদ বাড়িয়ে চলেছি?
লেখক-
বি.কম (অনার্স)
এম.বি.এস (হিসাব বিজ্ঞান)
ইডেন মহিলা কলেজ
আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে মেজর জলিল -মু. শাহাদাৎ হোসাইন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরত্ব শৃংখলাও স্বার্বোভৌমত্বতার কথা ভাবলেই মেজর এম,এ জলিলের নাম চলে আসে। মেজর এম.এ জলিল একটি নাম, একটি ইতিহাস। তিনি ছিলেন একাধারে সংগ্রামী দেশপ্রেমিক সহজ সরল ও সাহসী, তেমনি ছিলেন সুশৃংখল ও অদম্য কষ্টসহিষ্ণু একজন সোনার মানুষ। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক সংগঠক অন্যদিকে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সেনা নায়ক। তাই তিনি ছিলেন একজন চৌকস মানুষ। সৈনিক জীবনে তাকে যেমন করেছেন সাহসী সুশৃংখল ও কষ্ট সহিষ্ণু আর মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণে তাকে করেছে আরো লড়াকু। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এ েেত্র তিনি বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হন। আর তিনি সাহসীকতার সাথে কাজ করতে সবসময় বেশি পছন্দ করতে তাই আমৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রামী জীবন তাকে করেছিল অকুতোভয় প্রতিবাদী শোষক ও লুটেরা শাসনের প্রতি দৃঢ় আপোসহীস। অবশেষে আদর্শিক চিন্তাকে পরিবর্তন ও ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন তাকে দিয়েছিল জীবনের চরম পূর্ণতা। তাই তিনি বলেছেন মানুষের অন্তরের অন্ত:স্থলে রয়েছে সত্য ও মুক্তি অনুসন্ধানের আজন্ম পিপাসা। আমার জীবনের ল্য অর্জনে আমি অটল, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা আমার স্বভাব নয়। এটাই একজন মুসলমানের প্রকৃত সিফাত বা গুণ। তিনি জন্মের আগেই এতিম হন। ১৯৪২ সালের ৯ই ফেব্র“য়ারি বরিশালের উজিরপুর থানা সদরে মামার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার সংগ্রাম যেন জন্মের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। জীবনের প্রথমভাগে বিভিন্ন কঠোরতার সম্মুখীন হন। এই পৃথিবীতে তার মায়ের ভালোবাসা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
১৯৬০ সালে স্থানীয় ড.ই. ওহংঃরঃঁঃব থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এ সময় তিনি দুটি উপন্যাস “পথের কাঙ্গাল” ও “রীতি” রচনা করেন। যদিও পরবর্তীতে পান্ডুলিপি ২টি হারিয়ে যায়। ১৯৬১ সালে তিনি ইয়াং ক্যাডেটে ভর্তি হন। পাকিস্তানেও তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে ওহঃবৎসধফরধঃব পাশ করেন এবং কাবুলে সামরিক একাডেমীতে প্রশিণ নেন। ১৯৬৫ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন এবং আর্টিলারিতে যোগদেন। একই বছরে তিনি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে ১২নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালে সামরিক একাডেমি থেকে এৎধঃঁধঃরড়হ অর্জন করেন। পরে তিনি ইতিহাসে এম এ পাশ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি ছুটি নিয়ে অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে আসেন। ২৫ মার্চের কালোরাতে দেশের চেহারাটা পাল্টে যায় এবং ২৬ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল ও পটুয়াখালীকে মুক্ত অঞ্চল হিসেবে বজায় রাখতে সম হয়। ৭ এপ্রিল মেজর জলিল খুলনা রেডিও ষ্টেশন মুক্ত করতে অপারেশন চালান আবার ২১ এপ্রিল অস্ত্র সংগ্রহে সুন্দর বনের পথ ধরে তিনি ভারতে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করে মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৬ ডিসেম্বর স্বদেশ স্বাধীন হয়। ১৮ ডিসেম্বর তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং ২৬ ডিসেম্বর বরিশালের হেমায়েত উদ্দীন খেলার মাঠে তিনি ভাষণ দেন।
সেখানে তাকে সংবর্ধনা দিতে অভূতপূর্ব লোকের সমাগম হয়। স্বাধীনতার পর ভারত স্বদেশকে তাদের একটা প্রদেশ বানাতে চেয়েছিল এবং সেদেশের সেনাবাহিনী এদেশের সম্পদ ও কর্তৃত্ব কেড়ে নিতে চেয়েছিল। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনের পাঁচটি আসনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং নির্বাচনে তার বিজয় ছিল সুনিশ্চিত কিন্তু মতাসীন আওয়ামীলীগ তাকে বিজয়ী হতে দেয়নি।
বলা বাহুল্য রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপ ছিলেন মেজর এম এ জলিল। ১৯৭৪ সালে ১৭ মার্চ স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেড়াও কর্মসূচীতে পুলিশ গুলি করলে জাসদের বহু নেতা নিহত হন।
মেজর জলিল নিজেও হন আহত। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৮ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৩ নভেম্বর আবার গ্রেফতার করা হয়। সাময়িক আদালত কর্ণেল তাহের ও মেজর এম এ জলিল ফাঁসির আদেশ হয় পরে মুক্তি যুদ্ধের বিশেষ অবদানের জন্য মৃত্যুদন্ড মওকূপ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রায় সাড়ে চার বছর কারা ভোগ করার পর ১৯৮০ সালে ২৬ শে মার্চ মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৮২ টাঙ্গাইলের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কন্যা সায়মা আক্তার কে বিয়ে করেন এবং তাদের ঘরে সারাহ ও ফারাহ নামে দু’কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। এদিকে মেজর জলিলের চিন্তা চেতনার ক্রমশ পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ১৯৮৪ সালের ৩ নভেম্বর জাসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “ দলীয় জীবনে জাসদের নেতা কর্মীরা ধর্র্মীয় মূল্যেবোধ প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়েছে। এ বিসর্জন দেওয়ার ফলে নৈতিকতা ও মূল্যেবোধে পরিচালিত মানব দেহ থেকে নিজেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সমাজে বসবাসরত জনগণকে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সংস্কৃতির জীবন এবং মূল্যেবোধ থেকে মোটেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। প্রচলিত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনধারা থেকে কেবল নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখলেই বিকল্প সংস্কৃতির জন্ম নেয় না। বরং এ ধরনের রণকৌশল অবলম্বন সমাজে প্রচলিত নীতি নৈতিকতা আচার অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক মূল্যেবোধের প্রতি তাচ্ছিল্য উপহাস ঘৃণার বহি:প্রকাশ ঘটায় যা প্রকারান্তরে বিপ্লবী আন্দোলনের বিপে চলে যায়।” ইসলাম ধর্ম এদেশের ৯০% গণমানুষের কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসই নয় ইসলাম ধর্মভিত্তিক নীতি-নৈতিকতা আচার অনুষ্ঠান উৎসব পর্ব সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং এ দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রবাহের সাথে ইসলামী আদর্শ অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। জন্ম থেকে শুরু করে জানাজা পর্যন্ত ইসলামের নীতি নির্দেশের আওতায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের জীবন ।
এমন একটি জীবন দর্শনকে অবহেলা উপো কিংবা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে চলার নীতিকে বাস্তবসম্মত কিংবা বিজ্ঞানসম্মত বলা হয় না। প্রগতিশীল আন্দোলনের স্বার্থেই ইসলাম ধর্মের বিজ্ঞান সম্মত মূল্যায়ন অত্যাবশ্যকীয় বলে আমি মনে করি। কারণ ইসলাম শোষণ, জুলুম ,অন্যায়, অসুন্দর সহ সব রকম স্বৈরশাসন এবং মানুষের ওপর প্রভূত্বের ঘোর বিরোধী। ইসলাম পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ রাজতন্ত্র উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ সব মালিকানা একমাত্র আল্লাহরই। মানুষ হচ্ছে তার কেবল প্রয়োজন মেটানোর জন্য আমানাতদার বা কেয়ার টেকার ( তথ্য সূত্র কৈফিয়ত ও কিছু কথা গ্রন্থ)।
সেনা নায়ক মেজর এম এ জলিল এমন কিছু গ্রন্থ লিখে গেছেন যা আমাদের জীবনের সর্বণে দিক নিদের্শনার বাতিঘর। তার রেখা “অরতি স্বাধীনতাই পরাধীনতা”। দেশ প্রেমের বলিষ্ঠ ও উচ্চকিত শ্লোগানের রূপান্তরিত হয়েছে। তার লেখা কয়েকটি বই : সীমাহীন সমর( মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির ডায়েরী), মার্কবাদ ( প্রবন্ধ), সূর্যোদয় (রাজনৈতিক উপন্যাস), কেফিয়াত ও কিছু কথা (প্রবন্ধ), দাবী আন্দোলন দাযিত্ব (প্রবন্ধ), দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন দর্শন (প্রবন্ধ) অরতি স্বাধীনতাই পরাধীনতা (প্রবন্ধ) অংবধৎংয ভড়ৎ ওফবহঃরঃু (ঊধংংধুং) জাসদ থেকে পদত্যাগ করার ১৬দিন পরে তিনি “জাতীয় মুক্তি আন্দোলন” নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই সময় তিনি মরহুম হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে “সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ” গঠনে অংশ নেন। ১৯৮৫ সনের জানুয়ারীতে তাকে গৃহবন্ধী করা হয়। একমাস ছিলেন বন্ধি। সৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারনে ১৯৮৭ সালের ৩০শে ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৮ সালে মার্চ পর্যন্ত সরকার তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আঠক রাখে। এর আগে মেজর এম.এ জলিল লিবিয়া, লেবানন, ইরান, ব্রিটেন ও পাকিস্থানে কয়েকদিন আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালের ১১ নভেম্বর তিনি পাকিস্থানে যান। ১৬ নভেম্বর ইসলামাবাদে তিনি হৃদ রোগে আক্রান্ত হলে সাথে সাথে কিনিকে ভর্তি করা হয়। ১৯ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় এ মহানায়কের যবনিকা ঘটে। ২২নভেম্বর তার মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। সম্পূর্ণ সামররিক মর্যাদায় তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাকে দাফনের মাধ্যমেই মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে লাশ দাপন শুরু হয়। তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক থেকে ইসলামের মহানায়কে পরিণত হতেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন তার সংগ্রামী জীবনকে ইসলামের রঙে রঙিন করতে।
তাই তাকে ইসলাম বিরোধীতাকারীরা সহজে সহ্য করতে পারতেন না। কারণ তার জীবন হয়ে উঠেছিল ইসলামের শানিত তরবারীর ন্যায় গণমানুষের তরে কথা বলার কারণে। তাই তাকে সহ্য করতে হয়েছে বিষেধাগার যন্ত্রনা। আধিপত্যবাধীদের প থেকে তাই বলা যায় তিনি তার জীবনের সকল কর্ম কান্ডের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি কারো কাছে নয়, মহান প্রতি পালকের কাছেই শুধুমাত্র মাথানত করতে জানতেন। বিনম্র শ্রদ্ধাভরে স্মরন করছি এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। কারণ আমাদের কান্তিকালে তাঁরমত জলিলের খুবই দরকার।
লেখক:
শিার্থী, বি.এ (অনার্স) এম,এ (ইংরেজী)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
টিভি কম দেখুন সময়কে কাজে লাগান -শাহ আবদুল হান্নান
টেলিভিশন আধুনিক সভ্যতার একটি বড় অবদান। আজকে এর ফলে বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে, যোগাযোগ বৃদ্ধি হয়েছে। মানুষের পরস্পরের জানাজানির সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। এসবই বিজ্ঞানের অবদান।
বিজ্ঞানের এ যুগে আমাদের অবশ্যই টেলিভিশনের পজেটিভ দিকটি দেখতে হবে। টেলিভিশন আবিষ্কারের পর থেকে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। ভালোমন্দ, সুবিধা-অসুবিধার দিকসহ এর সামগ্রিক প্রভাব আজ আমাদের কাছে স্পষ্ট। বর্তমানে আমরা এমন পযার্য়ে এসে পৌছেছি যে, টেলিভিশনের খারাপ দিকগুলো রিভিউ করে দেখার প্রয়োজন। আমি ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় দেখেছি অনেক বাড়িতে টিভি রাখা হয় না। এ মানসিকতা সম্পন্ন লোক সেখানে আছে। তবে অন্যান্য দেশের কথা আমি ঠিক বলতে পারব না।
বছর তিনেক আগে আমার এক ছাত্র আমাকে একটি বই উপহার দেয়। বইটির নাম ছিল (ঋড়ঁৎ অৎমঁসবহঃং ভড়ৎ ঃযব ঊষবসরহধঃরড়হ ড়ভ ঞবষবারংরড়হ) লেখক ঔবৎৎু গবহফবৎ, বইটি আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়। সেখানে টেলিভিশনের তিকর ছয়টি দিক তুলে ধরে বলা হয়েছে, এ ছয়টি কারণে টিভি বন্ধ করে দেয়া উচিত। এছাড়াও ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে টেলিভিশনের তিকর দিকগুলো আমাদের সামনে বিভিন্ন সময় তুলে ধরা হয় এসব কী প্রমাণ করে? এসব প্রমাণ করে যে টিভির ব্যবহার বা টিভির কল্যাণকামিতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। তবে সে প্রশ্ন কতটুকু সঠিক আমি সে সামগ্রিক আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু সে প্রশ্ন উঠেছে, আর তা উঠেছে পাশ্চত্য দেশগুলোতে। একরম বই আমাদের দেশেও লেখা হয়নি।
আমাদের দেশে সরকারি, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো উন্মক্ত। এসব চ্যানেলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান দিকটি হলো খবর। এরপরই দেখা যায় নাচ, গান আর সিনেমা। নাচ, গান, সিনেমাই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ৫০ থেকে ৬০ ভাগ জুড়ে রয়েছে। সেখানে খেলাধূলার প্রোগ্রাম রয়েছে। তবে খেলাধুলার জন্য কয়েকটি আলাদা চ্যানেলই আছে। ২৪ ঘন্টাই খেলাধূলা সংক্রান্ত অনুষ্ঠান সেখানে দেখানো হচ্ছে। আবার কার্টুন চ্যানেলও আছে। কিন্তু সমাজের এর প্রভাব কি পড়ছে? বাস্তবে এটিকে কীভাবে দেখা হচ্ছে এবং মানুষের সময় কীভাবে ব্যয় হচ্ছে? সার্বিকভাবে আমরা দেখতে পাই শিশু- কিশোর থেকে যুবক শ্রেণী পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে অনেকেরই ৬/৭ ঘন্টা টেলিভিশনের পিছনে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা স্পোর্টস এডিকশনের বা নেশার ফলে ৫/৬ ঘন্টা খেলা দেখার জন্য ব্যয় করছে। এটি অনেকের েেত্র প্রযোজ্য। এতে তাদের অন্যান্য কাজের ব্যাঘাত হচ্ছে। লেখাপড়ার তি হচ্ছে। তেমনি বাচ্চারা কার্টুন নিয়ে প্রায় ব্যস্ত থাকে। আবার কার্টুনের সব ভালো আমি বলবো না। সেখানেও মারামারি আছে, অস্ত্র চালানোর ব্যাপার আছে সেসব দেখে বাচ্চাদের একটু বয়স হলে তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, আমার বন্দুক কোথায়? একজন যদি তার দিনের ৪ বা ৬ ঘন্টা টেলিভিশনের পিছনে ব্যয় করে তাহলে অবস্থা কেমন দাড়াঁয়।
তুলনামূলক ভাবে ভালো প্রোগ্রাম হলেও সেখানে ৪/৫ ঘন্টা ব্যয়ের প্রশ্ন চলে আসে। আমাকে বিভিন্ন ব্যক্তি টিভি সিরিয়ালের কথা বলেছে সেগুলো কতটুকু ভালো, কতটুকু কল্যাণকর আর জ্ঞানের, আমি সে বিষয়ের দিকে যাবো না। এ সিরিয়াল, মেগাসিরিয়াল প্রোগ্রামের একটি প্রভাব হলো, এর ফলে মহিলারা এ প্রোগ্রাম দেখতে যেয়ে প্রতিবেশীর সাথে দেখা-সাাতে সময় বের করতে পারেন না। আগে মহিলারা যেভাবে এক বাড়িতে থেকে আরেক বাড়িতে যেতেন,পারস্পরিক যোগাযোগ রা করতেন পাশের বাড়ি যেতেন সেটা কমে এসছে এবং তারা সর্ম্পূণ ঘরমুখী হয়ে যাচ্ছেন। তাদের মাথায় থাকছে কোন কোন সময় কোন প্রোগ্রাম শুরু হবে আর কোনটা দেখতে হবে। এর ফলে দেখা গেছে আমাদের সামজিকতা পর্যন্ত তিগ্রস্থ হয়ে গেছে। এতে আমাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, কল্যাণকামিতা,খোজঁ খবর নেয়া ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
এ স্পোর্টসে, কার্টুন, নাচ, গান সিনেমা কিংবা সিরিয়াল মেগাসিরিয়াল প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষের যে খুব একটা মানসিক উন্নয়ন হয় কিংবা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় তা বলা যায় না। এর সার্বিক প্রভাব নৈতিকও নয়, কল্যাণকরও নয়। কিছু কিছু ভালো প্রোগ্রাম আছে। এ বিষয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু সার্বিক প্রভাব কল্যানকর তা বলা মুশকিল।
টেলিভিশন প্রসঙ্গে আমি এখানে যে বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই তা হচ্ছে সময় অপচয় প্রসঙ্গ। টেলিভিশন প্রোগ্রামে মধ্যে কতটা আদর্শ, নৈতিকতা আছে আর কতটা নেই এসব আলোচনা আমার আজকের মূল বিষয় নয়। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে যে, এতে কতটা সময় যাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যেই ল্য করেছি ছেলেমেয়ে, বাচ্চা, গৃহিনী আর ছাত্রদের কি পরিমাণ সময় টেলিভিশনের প্রোগ্রামের পিছনে যায়। আমরা এও ল্য করলাম যে এ সময়ের পরিমান দিনে ১ ঘন্টা নয়, বরং গড়ে ৪ ঘন্টা ৫ ঘন্টা যাচ্ছে। কোনো কোনো েেত্র ৭/৮ ঘন্টাও যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি জাতির জন্য ভয়াবহ তিকর। একটি স্টাডিতে দেখা গেছে যে. একজন মানুষের ৫০/৬০ বছরের জীবনে ১২ বছর সময়ই ব্যয় হয়েছে শুধু টিভির পিছনে। একটি জীবনে যদি এ ১২ বছরই টিভির পিছনে যায় তাহলে তার অবস্থা কেমন আমরা কল্পনা করতে পারি। উৎ.ঐরংযধহ অষঃধষরন তার ঞৎধরহরম এঁরফব ঋড়ৎ ওংষধসরপ ডড়ৎশবৎং বইতে এ হিসাবের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর সমাধান কি? আমার মনে হয় এর জন্য একটি আন্দোলন দরকার। এ আন্দোলন সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক সকল পর্যায় থেকে করতে হবে। সে আন্দোলনের শ্লোগান হবে - ‘আমরা টিভি দেখব কম’। এখানে আমরা টিভি দেখব না বা টিভি ব্যান্ড করে দিতে বলছি না। এখানে আমরা শুধু বলছি, টিভি দেখার সময় আমাদের কমাতে হবে। যে যার পছন্দ অনুযায়ী টিভি প্রোগ্রাম বেছে নিতে পারে। কিন্তু এ জন্য সারাদিনই তাকে টিভি দেখতে হবে তাঁর কোনো যৌক্তিকতা নেই। যে খবর দেখতে চায় দেখবে। কেউ তার নিজের সবচেয়ে বেশি পছন্দের অনুষ্ঠান বেছে নিয়ে যদি শুধু সেটিই সীমিত সময় দেখে তাহলেও তার অনেক সময় বেঁেচ যায়। দিনে ১/২ বার খবরসহ সপ্তাহে কিছু ভালো অনুষ্ঠান কিংবা শিমূলক অনুষ্ঠান, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি দেখল। তবে আমাদেরকে টিভি দেখার সময় অবশ্য অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে যদি আমরা জাতি গঠন করতে চাই। জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে সময়। সময় হচ্ছে জীবন। জীবন হচ্ছে সময়। সময়ই যদি আমরা অপচয় করে দেই তাহলে কি করে আমাদের উন্নতি সম্ভব হবে। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক কোনো উন্নয়নই সময়ের সদ্ব্যবহার ছাড়া সম্ভব নয়। “তাই আমাদের শ্লোগান হওয়া উচিত আমরা টেলিভিশন কম দেখব এবং আমরা সময়কে কাজে লাগাব।” এর ফলে যে বিশাল সময় বেঁেচ যাবে তা আমরা ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারি। যেমন আমরা আমাদের ছাত্রজীবনের সময়গুলোতে বিভিন্ন সাহিত্য পড়তাম। নবী রাসূলের জীবনী, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য পড়তাম।
আজকের দিনে সেগুলো পড়ার সংখ্যা খুবই কমে গেছে। এটি যে কত বড় তি তা আমরা একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারব। সাহিত্য না পড়ার জন্যও সময়কে অনেক েেত্র দায়ী করা হয়। সাহিত্য হচ্ছে মানুষের জীবনের দর্পণ। এটি একটি দিক। অন্যদিক হচ্ছে সাহিত্য মানুষকে মহৎ করে। যারা ওয়ার্ল্ড কাসিক পড়বে, টলষ্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, পার্লবাক আর রবীন্দ্রনাথ হোক বা আল্লামা ইকবাল হোক, নজরুলের হোক তারাই জীবনে মহৎ হবে। এদের দ্বারা মানবতা কল্যাণ পাবে। অথচ আজকে সে রকম লোক তৈরি হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো বেশির ভাগ লোক আজকে সাহিত্য পড়ছে না। যখন একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে সেখানে সে প্রফেশনাল শিাই পাচ্ছে। সেখানেও সাহিত্যের গুরুত্ব কম। বাংলা পড়লে আমরা নাক সিটকাচ্ছি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বলছে এগুলো পড়ার দরকার কি? আমাদের সে শিা দরকার যা আমাদের কনস্ট্রাকশনের কাজে লাগবে । কিন্তু প্রকৃতপে এর দ্বারা মানুষ রোবট তৈরি হবে। মানুষ তৈরি হবে না । আমরা এ জিনিসটি ভুলে যাচ্ছি।
এ পরিস্থিতিতে আমার মনে হচ্ছে আমাদের একটি আত্মনিয়ন্ত্রণ দরকার। আমাদের সময় বাঁচাতে হবে। আমরা সময়কে বাঁচাবো । সময়কে মানবতার কাজে লাগাব মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করব। জাতির কল্যাণে জাতি গঠনে ব্যবহার করব। এ সময়কে আমরা ফ্যামিলির ডেভেলপমেন্টের কাজে ব্যবহার করব। নিজের আত্মগঠনে ব্যবহার করব। আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশীর জন্য ব্যবহার করব।
নিজেরা নিজেদের সময়কে বাঁচাবো। আমরা কতণ টিভি দেখব তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু সরকার চাইলে খারাপ চ্যানেলগুলো যতদিন পর্যন্ত ততদিন সেসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ উদ্যোগ অবশ্যই সরকারকে নেয়া উচিত। সরকারকে অবশ্যই এসব খারাপ চ্যানেলগুলে ব্যাপারে হস্তপে করতে হবে।
সর্বশেষে গোটা জাতির কাছে বলতে চাই সকলেই এ বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং প্রত্যেকেই তার নিজের ফ্যামিলিতে টিভি ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করবেন।
এ ব্যাপারে ফ্যামিলির মায়েদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। তারা নিজেরাই যদি বেশি করে টিভি দেখেন তাহলে বাচ্চাদের কে আটকানো সম্ভব হবে না বলে আমি মনে করি। এ বিষয়টি সকলেই বিশেষ বিবেচনা করে দেখবেন। পত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। এটি একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। যা আমাদেরই কল্যাণ হবে। আমার মতে,“আমরা টিভি দেখব কম ঃ সময়কে কাজে লাগাব” এ স্লোগান জাতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
লেখক ঃ
সাবেক সচিব
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
প্রিয়তম নবী (সা) এর আদর্শ অনুসরণ : প্রকৃত স্বরূপ -মু সাকিল উদ্দিন
মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে তাঁর বিধান দিয়েছেন দিক-নিদেশর্না হিসেবে। মানুষের মধ্য থেকেই একজনকে মনোনীত করেছেন নানা রকম সমাজ ও সম্প্রদায় থেকে। যাতে করে যে সমাজের মানুষ সে সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারে এবং আল্লাহ তায়ালার ওহী ভালভাবে বুঝতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুস্পষ্ট গ্রন্থের শপথ আমি এটা অবতীর্ণ করেছি কোরআন রূপে, আরবী ভাষায়, যাতে করে তোমরা বুঝতে পারো। এ গ্রন্থ মহান সারগর্ভ আমার নিকট সংরতি আছে। (সূরা-৪৩,আয়াত ২-৪)আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এ ঐশী গ্রন্থ এটি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানব জাতিকে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে আলোতে বের করে আনতে পার। তাঁর পথে যিনি পরাক্রমশালী’। (সূরা-১৪, আয়াত -১) আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা ( দ্বীনের ব্যাপারে) ভারসাম্য বজায় রাখ এবং এর ওপর মজবুত ভাবে কায়েম থাক। আর জেনে রাখ, তোমাদের কেউ তার আমলের সাহায্যে মুক্তি পাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বিশ্বজগতের প্রতিপালকের নিকট হতে এ গ্রন্থ অবতীর্ণ, এতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু ওরা বলে, এতো তার (মুহাম্মদের) নিজের রচনা। বরং এ তোমর প্রতিপালক হতে আগত সত্য’। (সূরা-৩২ আয়াত ১-৩)
এখানে আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শন করেছেন কোরআন নাযিল করে। যা জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শিক ও রহমত রূপে পাঠিয়েছেন মুহাম্মদ (সাঃ) কে। এখন নবী করিম (সাঃ) কে অনুসরণ করাই হলো আমাদের মূলকর্তব্য। আল্লাহ তায়ালার বিধান নবী (সাঃ) যেভাবে পালন করেছেন সেভাবে পালন করাই হলো সুন্নাত। আর জীবন যাপনের েেত্র নবী (সাঃ) -ই হচ্ছে সর্বোত্তম আদর্শ এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কাউকে দাতা বা অভিভাবক হিসেব গ্রহণ করা যাবে না। নবী কে যেমন তৎকালীন আরবের লোকেরা তাঁর বিশ্বস্ততায় আল আমীন উপাধি দিয়েছিল, তেমনি নবী (সাঃ) যখন লাত, মানাত উজ্জার মতো মূর্তি তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাস্য মানার বিরোদ্ধে এক আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দিলেন তখন তারাই তাদের এই প্রিয়তম ব্যক্তিটিকে মারধর করে বেহুশ করে ছাড়লো। এই হলো ঈমান আনা এবং ঈমানের দাওয়াত দানের পরিণাম। এভাবে এক পর্যায়ে নিজের বাড়ীঘর ছেড়ে প্রিয় নবীজীকে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। শিয়াবে আবু তালিবে তিনি আড়াই বছর কাটিয়েছেন। কতর্দূদশাগ্রস্থই না ছিলো সেখানের সময়গুলো। এরপর সর্বশেষ নিজের জন্মভূমি, পৈতৃক ভিটা, নাড়ীর টান ছেড়ে একেবারে ভিন্ন এলাকায় হিজরতও করতে হয়েছে।
যে কোনো জায়গায় গিয়েও পৃথিবীর সর্বোত্তম মানুষের কল্যাণকামী এই মহান ব্যক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। বিশ্বাসঘাতকতা করে ইহুদীরা প্রতারণা করছে। আবার আরবের কুরাইশাও রণ সজ্জায় সজ্জিত হয়ে আক্রমণ করতে এসেছে। এসবই হয়েছে আল্লাহর বাণীকে বুলন্দ করার জন্যই। নবীর (সাঃ) অনুসারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মানুষগুলো সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) তাদের গোটা জীবনটাই নবীর সাথে কাটিয়েছেন। তারা পার্থিব সুখ, ধন সম্পদ, পিতামাতার স্নেহ ভালোবাসা সন্তানের মায়ার পিছুটান সব কিছুকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নবীজীর (সাঃ) সাথে একেবারে হিজরতও করলেন। সুতরাং এখনো যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং রাসূলের প্রতি ঈমান আনতে হয় তাহলে সেই রকম যুলুম নির্যাতনের শিকার হতেই হবে এটাই ইসলাম বিরোধীদের আচরণ।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ঃ দেশে দেশে, যুগে যুগে -শাইখ মাহদী
একটি দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বের, মর্যাদার আর আবেগের বিষয়টি কি? একবাক্যে আমরা স্বীকার করে নেব, অবশ্যই স্বাধীনতা। আর তা যদি হয় রক্ত দিয়ে কেনা, তাহলে? সেই সংগ্রাম আর সংগ্রামী মানুষেরা চিরভাস্বর হয়ে বেঁচে থাকে সেই দেশের ইতিহাসে, মানুষের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে।
গৌরবময় এ স্বাধীনতার মাস - মার্চ। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর থেকে কেবল জুলুম আর পদে পদে নিপীড়ন, একাত্তরের মার্চের সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি আর তারই মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা, এই বাংলার খেটে খাওয়া নির্যাতিত মানুষের জীবনে এনে দিয়েছিল এক মৃত্যুঞ্জয়ী স্বপ্ন; যে স্বপ্নের বাস্তব রূপ ন’মাস পরে প্রতিভাত হয় সূর্যের আলোর চেয়েও উজ্জ্বলভাবে, এই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির জন্ম হবার মধ্য দিয়ে। এ সংগ্রাম বড়ই গৌরবের, আর তাই শিল্পে, সাহিত্যে, সমাজের নানা স্তরে এমনকি রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির মাঝেও এ মহান সংগ্রামের চেতনার প্রয়োগ, অতিপ্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ আমরা দেখে আসছি গত চল্লিশ বছর ধরে।
তবে এরকম গৌরবজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস বিশ্বের আরও অনেক দেশে রয়েছে, তবে সেগুলো সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান মোটামুটি সীমিতই বলা চলে। আজকে মহান স্বাধীনতার এ মাসে বিশ্বের আরও কিছু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমরা এখানে তুলে ধরব, যাতে করে ভ্রাতৃপ্রতিম এবং প্রতিবেশী বা সহযোগী দেশগুলোর আত্মদানের ইতিহাস, সে দেশের মানুষের আবেগ-ভালবাসা ও মনমানসিকতার উপর আমরা একটি স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে পারি।
প্রাচীনতম স্বাধীনতা সংগ্রাম: স্কটল্যান্ড
স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামই সম্ভবত আমাদের জানা ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। দু’টি পর্যায়ে এ সংগ্রামটি সম্পন্ন হয়, যার মধ্যে প্রথম পর্যায়ের স্থায়িত্ব হল ১২৯৬ থেকে ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দ আর দ্বিতীয়টি ১৩৩২ থেকে ১৩৫৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যে মহান সংগ্রামী যোদ্ধার অধ্যাবসায় আর কঠোর পরিশ্রমের কথা আমরা সবাই জানি, সেই রবার্ট ব্র“স এই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে স্কটল্যান্ডকে মুক্তি দেন, আবার তাঁর পুত্র ও বংশধরেরাই স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশেষ পর্যন্ত এর নেতৃত্ব দেন।
১২৯৬ সালে স্কটিশ রাজা ৩য় আলেক্সান্ডার তার অল্পবয়স্কা নাতনী মার্গারেটকে উত্তরাধিকারী রেখে মারা যান। স্কট সাম্রাজ্যের প্রভাবশালীরা তখন মার্গারেটকে ইংল্যান্ডের রাজা ১ম এডওয়ার্ড এর ছেলের সাথে বিয়ে দেয়। ক’মাস পর কোন কারণে মার্গারেট মারা যান এবং সুচতুর এডওয়ার্ড স্কটল্যান্ডকেও ইংলিশ রাজত্বের একটি অংশে পরিণত করেন। এর পরিপ্রেেিত শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইংল্যান্ডের সাথে স্কটল্যান্ডের যুদ্ধ। বারংবার পরাজিত হয়েও রবার্ট ব্র“স কিভাবে তার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন, সে গল্প আমরা সবাই জানি। ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্পাদিত এডিনবার্গ-নর্দাম্পটন চুক্তির মাধ্যমে এর একটি আপাত সমাপ্তি দেখা যায়।
তবে রবার্ট ব্র“সের মৃত্যুর পর আবারও ব্রিটেন তার চুক্তি ভঙ্গ করে স্কটল্যান্ডে আগ্রাসন চালায়। এক দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৩৫৭ সালে বারউইক চুক্তির মাধ্যমে স্কটল্যান্ড সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ আগ্রাসন মুক্ত হয়। এ সংগ্রাম মধ্যযুগের ইতিহাসে এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। অস্ত্র হিসেবে ‘লং বো’ - বড় আকারের ধনুকের ব্যবহারও ঐ সময় শুরু হয়। ২৯টি বড় যুদ্ধ এবং চারটি চুক্তির সমন্বয়ে গঠিত এ সংগ্রামের স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় ৫৭ বছর।
ডাচ বিদ্রোহ: স্বাধীনতাকামী নেদারল্যান্ডস
স্প্যানিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইউরোপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৫৬৮ সালে শুরু হওয়া এ বিদ্রোহ শুরু হয়। মূলত ১৫৫৬ সালে ডাচ রাজা চার্লস মারা গেলে তার পুত্র ২য় ফিলিপ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে অধিষ্ঠিত হন, যার বাল্যকাল এবং শিাদীা সবই সম্পন্ন হয় স্পেনে। ফিলিপ সম্পূর্ণভাবে স্প্যানিশ ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছিলেন এবং ডাচ ভাষায় কথা পর্যন্ত বলতে পারতেন না। এ বিদ্রোহ প্রাথমিকভাবে স্পেন চেপে রাখতে সম হয় ১৫৭২ সাল পর্যন্ত, কিন্তু এরপর তা নেদারল্যান্ডসের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ১৫৮৫ থেকে ১৬০৯ এ চব্বিশ বছরে খন্ড খন্ড ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল বিদ্রোহীদের দ্বারা ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো, ডাচ সাম্রাজ্য অধিকার করার জন্য! এছাড়াও সুবিখ্যাত স্প্যানিশ নৌবহর আর্মাডা কে প্রতিরোধের জন্য ডাচ বিদ্রোহীরা শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলে। একই সাথে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠিত হয়, দূর প্রাচ্যে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করবার জন্য।
বিদ্রোহের মাত্রা যখন তুঙ্গে তখন স্প্যানিশ প বাধ্য হয় বিদ্রোহীদের সাথে একটি শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। যার মেয়াদ ছিল বারো বছর, ১৬০৯ থেকে ১৬২১ সাল পর্যন্ত। এরপরও বিপ্তি ঘটনাবলীর মাধ্যমে ডাচ উপনিবেশের বিভিন্ন এলাকা কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তবে স্পেন মরণ কামড় দিতে ভোলেনি। ১৬৩৯ সালে ২০,০০০ সৈন্যের সমন্বয়ে একটি বাহিনী পাঠায় স্পেন, নেদারল্যান্ডসে এসে যা বিদ্ধস্ত হয়ে যায়। এরপর ১৬৪৮ সালে মুনস্টার চুক্তির মাধ্যমে স্পেন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, সমাপ্ত হয় আশি বছরব্যাপী দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম।
হৃত-রাজ্য পুনরুদ্ধার: পর্তুগালের স্বাধীনতা
পর্তুগালের সাম্রাজ্যে স্প্যানিশ আগ্রাসনের কারণে কিছুকালের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা হারায় দেশটি। ১৬৪০ সালে ব্রাগানসা রাজবংশের শাসনকালে এ স্প্যানিশ সম্রাট ফিলিপের আক্রমণ দেশের শাসকগোষ্ঠীকে পরিণত করে এক পুতুল সরকারে। স্পেনের এ ধরণের কার্যকলাপ ব্যতিব্যস্ত করে তোলে আশেপাশের রাজ্যগুলোকেও। তাই তৎকালীন ফরাসী সম্রাট ত্রয়োদশ লুইয়ের উপদেষ্টা কার্ডিনাল রিশালিও নিজেদের স্বার্র্র্থেই পর্তুগীজ শাসক চতুর্থ জোয়াও কে সাহায্য করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৬৫৪ সালে জোয়াও এর সাথে ইংরেজ রাজা ক্রমওয়েলের একটি পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পন্ন হয়। পরের বছর জোয়াও মারা যান এবং তার ছেলে ষষ্ঠ আলফানসোর পে জোয়াওর স্ত্রী এবং আলফানসোর মা রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন।
তবে ১৬৫৯ সালে পিরেনিজ চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়ে যাওয়ায় চাপে পড়ে পর্তুগাল। তবে ১৬৬৫ সালের মন্টি-কার্লোতে সংঘটিত যুদ্ধে পর্তুগালের কাছে পরাজিত হয় স্পেন। পরবর্তীতে ১৬৬৮ সালে লিসবন চুক্তির মাধ্যমে পূর্ণভাবে স্বাধীনতা পায় পর্তুগাল, স্প্যানিশ আগ্রাসন তার থাবা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
হাঙ্গেরী - সংগ্রামী স্বাধীনতা:
ষোড়শ শতাব্দীতে তুরস্কের উসমানিয়া খিলাফতের অধীনে আসে হাঙ্গেরী। সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হন বিদ্রোহী নেতা ইমরে থকোলী, যার হাত ধরে পোলিশ হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের হাত থেকে মুক্তি পায় হাঙ্গেরী। তবে সতেরো শতকের মাঝামাঝিতে পুনরায় হাঙ্গেরী দখল করে নেয় স্পেন, আর এই হাঙ্গেরীকে পুনরায় স্বাধীনতা দিতে এগিয়ে আসেন অভিজাত সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ফ্রান্সিস রাকোজ্জি। তার নেতৃত্বে শাসকগোষ্ঠীর বিপে সশস্ত্র সংগ্রামে এগিয়ে আসে বিদ্রোহীরা। হাঙ্গেরীয়ান অভিজাত ও নেতৃস্থানীয় সমাজ রাকোজ্জিকে প্রিন্স উপাধিতে ভূষিত করে। তবে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যস্থতায় রাকোজ্জি এবং শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয় ১৭০৫ সালে।
তবে ১৭০৮ সালে ট্রান্সেইন যুদ্ধের এক পর্যায়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়েন রাকোজ্জি, আর তাকে মৃত ভেবে হীনবল হয়ে পালিয়ে যায় তার যোদ্ধারা। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৭১১ সালে পূর্ণভাবে স্বাধীনতা পায় হাঙ্গেরী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: রক্তে কেনা স্বাধীনতা
বর্তমান পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ আমেরিকাও স্বাধীনতা পেয়েছে এক রক্তয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ কলোনীভুক্ত এ দেশটির এ সংগ্রাম শুরু হয় ১৭৭৫ সাল থেকে। এ সময় ব্রিটিশ অধিভুক্ত ১৩টি কলোনী (আজকের যুগের অঙ্গরাজ্য) বিদ্রোহ করে ইংল্যান্ডের বিপ।ে আমেরিকার সাদা মানুষেরাই ছিল এ বিদ্রোহের সংগঠক ও পরিচালক, যদিও তারা ছিল ব্রিটেন থেকে আগত। কালো দাস এবং রেড ইন্ডিয়ানরা ব্রিটেনকেই সমর্থন দেয়, এছাড়াও নাগরিকদের একটি বড় অংশই স্বাধীনতার যুদ্ধের বিরোধিতা করে। ঐতিহাসিকদের মতে একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দেয় ৪০-৪৫% মানুষ, বিরোধিতা করে ১৫-২০% এবং নিরপে থাকে ৩৫-৪৫% মানুষ। জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে এ সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে একে একে রক্তয়ী সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে ম্যাসাচুসেটস, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, ফিলাডেলফিয়াসহ আরও অন্যান্য রাজ্য। শক্তিশালী নৌবাহিনী থাকার কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ব্রিটেন তার অধিকার বজায় রাখতে পারলেও দেশের অভ্যন্তরভাগ, যেখানে ৯০% মানুষের বসবাস, সেখানে স্বাধীনতাকামীদের আধিপত্য ক্রমশ বাড়তে থাকে।
আমেরিকার এ স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে আমাদের এ উপমহাদেশের পরো কিছু সম্পর্ক রয়েছে। প্রথমত, আমেরিকায় সেনাসমাবেশ করতে গিয়ে অধিক সংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য প্রয়োজন হয়, সেই সৈন্য ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে গিয়ে মোতায়েন করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এ কারণে মহীশূরে টিপু সুলতান এবং ফরাসীদের মিলিত আক্রমণ প্রতিহত করতে বেগ পেতে হয় ব্রিটিশদের। এছাড়াও, আমেরিকায় স্বাধীনতাকামীদের বিপে ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন লর্ড কর্ণওয়ালিস, যাকে পরবর্তীতে ভাইসরয় করে ভারতবর্ষে পাঠানো হয়।
স্বাধীনতাকামীদের অব্যাহত আক্রমণ এবং পরাজয়ের ফলে ১৭৮৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিস আত্মসমর্পণ করেন জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে। এভাবেই জন্মলাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অগ্নিগর্ভ দণি আমেরিকা ও সাইমন বলিভার: সংগ্রাম-বিপ্লবের লীলাভূমি
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম তিরিশ বছরে একের পর এক স্বাধীন হতে থাকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো। মূলত এ দেশগুলোর বেশিরভাগই ছিল স্পেনের কলোনী। এ দেশটিতে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট আক্রমণ করে সম্রাট ৭ম ফার্ডিন্যান্ডকে উৎখাত করেন, যার ফলে হাজার হাজার মাইল দূরের উপনিবেশগুলোর দিকে মনোযোগ দেবার মত সুযোগ তাদের ছিল না, এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে একে একে স্বাধীনতা অর্জন করে চিলি, মেক্সিকো, ভেনিজুয়েলা, কলাম্বিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর এবং উরুগুয়ে।
চিলি:
১৮০৮ সালে ফ্রান্সিসকো গার্সিয়া কারাসকো নামক এক অত্যাচারী ব্যক্তি চিলিয়ান উপনিবেশের গভর্ণর জেনারেল নিযুক্ত হন। তিনি দমন-নিপীড়ন ও নির্যাতনের এক স্টিম রোলার চালানো শুরু করেন। মূলত তার বিরুদ্ধেই আন্দোলন শুরু হয়, যা মোড় নেয় স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে। মাতিও ডি তোরো ই জাম্বেরানো নামক ৮৩ বছর বয়স্ক এক প্রভাবশালী সৈনিকের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম এ বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮১০ সালে। পরবর্তীতে জোসে মিগুয়েল ক্যারেরা নামক এক সুচতুর উচ্চাভিলাসী যুবক নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে মতার মঞ্চে আরোহণ করেন। চিলি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা অর্জন করে ১৮১৮ সালে।
মেক্সিকো:
স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে ১৮১০ সালে, মিগুয়েল হিদালগো ই কসটিলার হাতে। তাকে ১৮১১ সালে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। তার পর বিদ্রোহীদের নেতা হন জো মারিয়া মোরালেস, তার নেতৃত্বে ১৮১৩ সালে মেক্সিকোর স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে ১৮২১ সালে কর্ডোভা চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে মেক্সিকো।
ভেনিজুয়েলা:
স্পেনের অন্তর্গত কলোনী ভেনিজুয়েলা ১৮১১ সালে সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করে। মহান বিপ্লবী সাইমন বলিভারের প্রত্য তত্বাবধানে থেকে রক্তয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৮২১ সালে স্বাধীন হয় দেশটি।
কলাম্বিয়া:
কলাম্বিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় ১৮১৫ সাল থেকে। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যেতে থাকে দেশটি, যার মধ্যে বুয়্যাকা যুদ্ধটি প্রণিধানযোগ্য। এ যুদ্ধে সাইমন বলিভার ৩০০০ সৈন্য নিয়ে আন্দিজ পেরিয়ে আক্রমণ করেন এবং জয়ী হন। ১৮২০ সালে সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে রাজধানী বোগোটা মুক্ত হয়। স্বাধীন কলাম্বিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন সাইমন বলিভার।
ইকুয়েডর:
আশেপাশের সকল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপ ইকুয়েডরেও এসে লাগে। ১৮২২ সালের ২৪ মে জেনারেল অ্যান্টোনিও জোসে ডি সুক্রে আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেন রাজধানী কুইটো।
বলিভিয়া:
ঔপনিবেশিক শক্তির বিরেুদ্ধে দেশটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৮০৯ সালে। রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পচিঁশ বছর পর ১৮২৪ সালের ৯ই ডিসেম্বর আয়াচুপে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয় বলিভিয়া। তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রনায়ক এবং মহান বিপ্লবী সাইমন বলিভার এর নামে দেশটির নামকরণ হয় বলিভিয়া।
উরুগুয়ে:
১৮১১ সালে স্পেনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয় স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। জোস গার্বাসিও আর্টিগাস এ আন্দোলনের অগ্রদূত। তবে স্প্যানিশ উপনিবেশের কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে ১৮২১ সালে ব্রাজিলের অংশ হিসেবে যুক্ত হয় উরুগুয়ে, যেখান থেকে আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশটি। অবশেষে ১৮২৮ সালে মন্টিভিডিও তে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে উরুগুয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।
গ্রীসের স্বাধীনতা: উসমানিয়া খিলাফতের ভাঙ্গন
১৮২১ সালে গ্রীস প্রথম এলাকা হিসেবে তুর্কী খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আলেক্সান্ডার ইপসিলান্টিস এর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে এ সংগ্রাম শুরু হয়। একে একে ক্রীট দ্বীপ, মেসিডোনিয়া সহ গ্রীসের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৮৩২ সালে কন্সট্যান্টিনোপল চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে গ্রীস। এ দেশটির স্বাধীনতা ইতিহাসের পাতায় একটি তাৎপর্য্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা এর মাধ্যমেই উসমানিয়া খিলাফতের ভাঙ্গনের সুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সিপাহী বিদ্রোহ: উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার
আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান দখল করে আছে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। ভারতের উত্তরাংশের বিভিন্ন প্রদেশে চলা এ বিপ্লব কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ রাজের সাম্রাজ্যের ভিতকে। ১০ই মে বাংলার ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া এ বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষজুড়ে। মুঘল সম্রাট ২য় বাহাদুর শাহ জাফরকে কেন্দ্র করে কানপুরের নানা সাহেব, ঝাঁসির রাণী লীবাঈ ও আরও অনেক শাসক ঐক্যবদ্ধ হয়ে যোগ দিয়েছিলেন এ সংগ্রামে।
মূলত ব্রিটিশদের অব্যাহত শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ােভ, নানান ধর্মীয়-সামাজিক কারণ এবং সর্বশেষে ‘এনফিল্ড প্যাটার্ণ ১৮৫৩’ রাইফেলের প্রচলন এ আগুনকে উস্কে দেয়। দাঁতে কেটে টোটা ব্যবহারের প্রযুক্তি ব্যবহৃত হওয়ায় গুজব রটে যে, এতে গরু এবং শুকরের চর্বি ব্যবহৃত হয়েছে। যার ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের সৈন্যদের মনেই তীব্র অসন্তোষ জেগে ওঠে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চে ৩৬ বিএনআই কোম্পানির মঙ্গল পান্ডে নামক এক সিপাহী ঐ কোম্পানীর জমাদার ঈশ্বরীপ্রসাদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিদ্রোহের সূচনা করে। শেখ পল্টু নামক একজন সিপাহী ছাড়া সকলেই তাদের সমর্থন করে। তবে ব্রিটিশ সেনারা সহজেই এ বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করে, মঙ্গল পান্ডে ও ঈশ্বরীপ্রসাদের কোর্ট মার্শাল করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় এবং শেখ পল্টু জমাদারের পদে উন্নীত হয়।
তবে পরবর্তী পর্যায়ে বিদ্রোহ চূড়ান্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কর্ণেল মুনরো ও অন্যান্য ব্রিটিশ অফিসারের চেষ্টায় এবং কিছু বাস্তব সমস্যার কারণে, মূলত যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এ বিদ্রোহ ব্যর্থতা পর্যবসিত হয়। তবে এটুকু লাভ হয় যে, ভারতবর্ষের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে সরাসরি ব্রিটেনের রাণীর হাতে ন্যস্ত হয়।
এছাড়াও এ বিদ্রোহ পরবর্তীকালের সকল স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণাদায়ক ভূমিকা পালন করে। ২০০৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের দেড়শত বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হয়।
রুমানিয়া: খিলাফতের ভাঙ্গন স্পষ্টতর
১৮৭৭ সালের এপ্রিলে রাশিয়ার প্রত্য মদদে উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রুমানিয়া, রাশিয়ার ১,২০,০০০ সৈন্যকে নিজ দেশে প্রবেশাধিকার দিয়ে। তুর্কী আক্রমণের বিরুদ্ধে এ বিপুল রুশ সৈন্যকে ঢাল হিসেবে রেখে ২১শে মে মিহেলি কোগালনিচেনিউ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যাতে রুমানিয়ান রাজপুত্র প্রিন্স ১ম ক্যারল অনুমোদন করেন। রুমানিয়া তখন থেকে তুর্কীদের কর দেয়া বন্ধ করে দেয় এবং সেই অর্থ যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে প্রদান করে। অব্যাহত চাপ ও সামরিক তৎপরতা চালানোর ফলে ১৮৭৮ সালে সান স্টেফানোতে শান্তিচুক্তি হয়, এর মাধ্যমে রুমানিয়া স্বাধীনতা পায়।
আয়ারল্যান্ড: রক্তাক্ত অভ্যুদয়
ব্রিটিশ রাজত্বের হাত থেকে মুক্তি পেতে আয়ারল্যান্ডে তৎপরতা শুরু হয় ১৯১৯ সালে। এ সময় আইরিশ পার্লামেন্ট একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে কাজ শুরু করে, যার নাম দেয়া হয় ড্যালিল ইরিয়ান। এই ড্যালিল এর প্রত্য তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (ওজঋ), যা সামরিক তৎপরতা শুরু করে। মাইকেল কলিন্স ছিলেন এর উদ্যোক্তা। এ সংগঠন তাদের গুপ্ত হামলার ল্যবস্তুতে পরিণত করে জওঅ কে, যারা ছিল রয়াল আইরিশ কনস্ট্যাবুলারি অর্থাৎ ব্রিটিশ অনুগত পুলিশ বাহিনী। অসংখ্য হত্যাকান্ডের পর ওজঋ গঠন করে ওচঋ - আইরিশ পুলিশ ফোর্স এবং স্থবির হয়ে পড়া ব্রিটিশ আদালতকে প্রতিস্থাপিত করে ড্যালিল কোর্ট দ্বারা। আর্থার গ্রিফিথকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেয় ওজঋ. অব্যাহত গুপ্তহত্যা ও রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯২১ সালে অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে আয়ারল্যান্ড। অবশ্য এর পরপরই এক রক্তয়ী গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দেশটির উত্তর ও দনি অংশ, আর এর বলি হন মাইকেল কলিন্স, আর্থার গ্রিফিথ।
বিংশ শতাব্দীর আরও কিছু স্বাধীনতা সংগ্রাম:
১৯৫৪ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় আলজেরিয়ায়, আধিপত্যবাদী ফ্রান্সের কবল থেকে থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য। অত্যন্ত নৃশংস ভূমিকা এখানে গ্রহণ করে দু’টি পই। তবে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ১৯৬০ সালে স্বাধীন হয় আলজেরিয়া। এছাড়াও ১৯৬১ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে অ্যাঙ্গোলা, স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭৪ সালে এলভোর চুক্তির মাধ্যমে।
এভাবেই যুগে যুগে স্বাধীনতা আন্দোলনে রক্ত ঝরিয়েছে পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ। আর এখনও ফিলিস্তিন, কাশ্মীরসহ আরও অনেক দেশে চলছে রক্তাক্ত সংগ্রাম। যেহেতু একটি গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তরাধিকারী আমরা, সে কারণে চলমান সকল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিও আমাদের সকলের শ্রদ্ধা থাকা উচিত। অত্যাচারী ও ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে একবিংশ শতাব্দির সকল সংগ্রামী মানুষেরা পাবে মুক্ত জীবনের স্বাদ, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন - এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
লেখক: শিার্থী, ঢাবি, আইন বিভাগ
বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বর্ণিল উদ্বোধন ঃ একটি কাপের জন্য লড়ছে ১৪টি দল -মফিজুর রহমান
ক্রিকেটের মহাযজ্ঞের মহা আয়োজনের সূচনালগ্নে ঐতিহাসিক নগরী ঢাকা বিশ্বকে স্বাগত জানাল দু’হাত প্রসারিত করে। ঢাকা সেই রস-রূপ ফুটিয়ে তুলল পরম লালিত্যে, নান্দন্দিকতায়। দৃশ্যটা অনভ্যস্ত। অভিনবত্বও বটে। রিকশায় বসে আছেন রিকি পন্টিং। কোনটাতে গ্রায়েম স্মিথ, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি কিংবা অ্যান্ড্র- স্ট্রাউস। ঢাকার আদিবাহনে চড়ে একে একে তারা প্রবেশ করলেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। যেন ক্রিকেটের বৈশ্বিক-গৃহপ্রবেশ হল। আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১১-র বর্ণিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এটিই সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং চিত্তাকর্ষক অংশ। গৌরবে-সৌরভে, রঙে-রূপে, আলোয়-আনন্দে মোহনীয় এক সন্ধ্যা আড়াই ঘণ্টা আবেশে বুঁদ করে রাখে ক্রিকেটবিশ্বকে। শিল্প ব্যাংকের ভবনে টানানো বিশাল পর্দায় ভেসে ওঠে যখন ফুটে ওঠে ছয় বলের এক ওভার, চার-ছয় মারার অনুপম দৃশ্য, ক্রিকেট তখন সত্যি যেন বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান ভাষা আন্দোলনের মাসে ভাষা শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে ছয় সপ্তাহের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। সুসজ্জিত ও হাইড্রলিক পদ্ধতির মঞ্চে ইবরার টিপু সহশিল্পীদের নিয়ে গাইলেন স্বাগত সঙ্গীতÑ ‘ও পৃথিবী এবার এসে ঃ বাংলাদেশ নাও চিনে, ও পৃথিবী ঃ তোমায় স্বাগত জানাই এই দিনে। তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান মিলা, কণা, এলিটা, বালাম, হƒদয় খান ও অর্ণব। ৪০ জন যন্ত্রশিল্পী ছিলেন সঙ্গে। এর পরই সেই চমৎকৃত কোলাজÑ ১৪ রিকশায় বসে ১৪ অধিনায়কের প্রবেশ। তাদের প্রত্যেকের পাশে শিশু। সবচেয়ে বেশি তালি পড়ল সাকিবের বেলায়। সবার আগে একটি রিকশা-ভ্যানে ছিল বিশ্বকাপের মাসকট স্টাম্পি। মাঠ প্রদণি শেষে ১৪ অধিনায়ক মঞ্চে দাঁড়ান পাশাপাশি। এরপর সনু নিগমের থিম সঙ্গীতের সঙ্গে চলে আতশবাজির খেলা। অনুষ্ঠানে তিন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ-পর্বে ফুটিয়ে তোলা হয় পলিমাটির আবহমান বাংলার কোমল সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য।
কানাডার জনপ্রিয় পপ গায়ক বহুবার গাওয়া শ্রোতা-জয় করা গান ‘সামার অব সিক্সটি নাইন’ গেয়ে শোনান। সবশেষে বলিউড সুরকারত্রয়ী শংকর-এহসান-লয় থিম সঙ গাইলেনÑ ‘দে ঘুমাকে ঃ’। আতশবাজির রোশনাই ছড়িয়ে শেষ হয় স্মরণীয় সন্ধ্যা। অন্যদিকে নিজেদের আঙিনায় এমন বিরল অনুষ্ঠান দেখা থেকে হাজার হাজার দর্শক বঞ্চিত হয়েছেন আয়োজকদের ঔদাসীন্য ও গাফিলতিতে। টিকিট কেটেও তারা মাঠে ঢুকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের আশপাশে বড় পর্দায় অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা না করায় অনেকে ব্যর্থ-মনোরথে ফিরে যান। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে আতশবাজির আলো দেখিয়ে সান্ত্বনা দেন। এর মাধম্যে পর্দা উঠল দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের। এ সময় আতশবাজির আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয় গোটা এলাকা। এত বড় মাপের ক্রীড়া আয়োজন বাংলাদেশে আগে কখনো হয়নি। সেদিক দিয়ে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সহ-আয়োজক দেশ হিসাবে নতুন ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ২০১১ সালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন আমাদের অভিভূত করেছে। বর্ণিল এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির উপস্থাপন এদেশীয় ক্রিকেটকে নতুন পরিচয় করে দিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুষ্ঠানে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের ক্রিকেটকে দেশে ও দেশের বাইরে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ক্রীড়া আসর দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর শুভ উদ্বোধন বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে প্রত্য করেছে অনন্য-অপূর্ব লাল-সবুজের বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর এমন বড় আনন্দের দিন আর কখনো আসেনি। সার্বিকভাবে ৩০ ল মার্কিন ডলারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি ছিল আবহমান বাংলাসহ উপমহাদেশের স্বকীয় ও গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্মারক।
ইতিহাসের সাী হলেন দেশের কোটি কোটি দর্শক
জনস্রোতের মতো চারদিক থেকে আসছিলেন দর্শক। নারী পুরুষ, ছোট ছেলেমেয়ে কেউ যেন বাদ যাচ্ছিলেন না। বেলা চড়া হওয়ার সাথে সাথে শাহবাগ মোড় থেকে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। মতিঝিল দৈনিক বাংলার মোড় থেকে প্রবেশ পথ বন্ধ করা হয়। জিরো পয়েন্ট ছিল বন্ধ। তারপরও পায়ে হেঁটে টিকিট হাতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দর্শকরা লম্বা লাইন দিয়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার জন্য যে উৎসাহ- উদ্দীপনা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তা ছিল লণীয়।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের চারদিক ঘিরে ছিল দর্শক আর দর্শক। যারা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ম্যাচ দেখার টিকিট পেয়েছিলেন তারা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিট পেয়ে বাড়তি সুযোগ গ্রহণ করেছেন। ১ হাজার, ১০ হাজার, ২০ হাজার টাকা একটি টিকিট মূল্য। টিকিট পাওয়া অভিজাত পরিবার থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য, এইসব ভাগ্যবান দর্শক ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে ইতিহাসের সাী হতে এসেছিলেন।
এদিকে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে অব্যবস্থাপনা ছিল গ্যালারির আসন ব্যবস্থাপনা নিয়েও। দর্শকরা কিভাবে কোথায় যাবে, তার জন্য কোনো ভলান্টিয়ার না থাকায় দর্শকরা স্টেডিয়ামে এসে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। টিকিট হাতে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করেছেন। তারপরও সান্ত্বনা আছে অনেক, আত্মতৃপ্তি আছে অনেক। নিজেদের মাঠে বিশ্বকাপ বলে কথা। যারা টেলিভিশন দেখছেন তারাও খুশি, আবার যারা স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছেন তারাও খুশি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করে ইতিহাসের সাী হলেন বাংলাদেশের কোটি কোটি দর্শক।
বিশ্বকাপে জয় পেতে শুরু করেছে টাইগারা : বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে একদিন, এই বিশ্বাস গেঁথে গেছে ক্রিকেটপ্রেমীদের হƒদয়ে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে হেরে কিছুটা নার্ভাস হয়েছিলো বাংলার টাইগারা। তবে ২য় ম্যাচে স্মরণীয় জয়ের মাধ্যমে সে নাভার্সভাব কেটে যায়। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা ভুলিয়ে বাংলাদেশকে অবিস্মরণীয় জয় উপহার দিলো টাইগার বোলাররা। দেশের সব ক্রিকেট অনুরাগীকে উৎসবে ভাসিয়ে দেয়ায় শুভেচ্ছা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবাইকে। পুরো ম্যাচ জুড়েই অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে দল। ম্যাচের দ্বিতীয় পর্বে দলীয় নৈপুন্যের নান্দনিক প্রদর্শনী ক্রিকেট অঙ্গনে টাইগারদের গৌরবময় পদচারণার ইঙ্গিত বহন করে। তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। আশা করি, সামনের ম্যাচগুলোয় ২০৫ রানের টার্গেটে জয়লাভ টাইগারদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পাশাপাশি সতর্কও করবে। স্বাগতিক দলের ওপর প্রত্যাশার চাপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে বিশ্বকাপের মতো আসরে ব্যাটসম্যানদের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অমনযোগী ব্যাটিং কাম্য নয়। ১৬ কোটি বাংলাদেশির হাত দু’পাশ থেকে আগলে রাখল একটি আশা। তা হলো বাঙালির বিশ্বকাপের আশা।
কে না চায় বিশ্বকাপ জিততে
আফ্রিদী, সাকিব, রিকি পন্টিং, কুমারা সাঙ্গাকারা, মাহেন্দ্র সিং ধোনি প্রত্যেকের চোখে এখন ভাসছে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সারাদেশে যে উন্মাদনা বইছে, ১৪ দলের অধিনায়কদের নিয়ে আইসিসির মিডিয়া সেশনে সেই উন্মাদনার ছোঁয়া টের পাওয়া গেল আরেকবার। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেই সব দেশকে নেতৃত্ব দেয়া ক্যাপ্টেনদের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো বিশ্বকাপ জেতার অঙ্গীকার। পন্টিং, সাঙ্গাকারা, ধোনিদের সেই প্রতিশ্রুতির সাথে তাল মেলালেন বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক সাকিবও। সাকিবের এমন সাহসী কথা অবশ্য বাকি অধিনায়কদেরও কিছুটা হলেও চমকে দিয়েছে। বিশ্বকাপ না জেতার আফসোস সেই ২৮ বছর ধরে। সবকটি টুর্নামেন্টে ফেভারিট হিসাবে অংশ নিলেও বিশ্বকাপ জেতা হয়নি তাদের। স্বাভাবিকভাবে এবার তাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান, ভারত বা শ্রীলংকার বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা বেশি, অন্তত ধোনি কিংবা সাঙ্গাকারার কাছে অংকের হিসাবও বেশ সহজ। এই টুর্নামেন্টেও ভালো লড়াইয়ের প্রত্যাশা করছেন স্মিথ যেমন, তেমনি পাকিস্তান অধিনায়ক আফ্রিদিও। কন্ডিশনের সাথে অবশ্য এখনো লড়াই করে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপ একটি, লড়বে ১৪টি দল। সারা দুনিয়া কাঁপানো টুর্নামেন্টে কেউ কোন ছাড় দিবে না, ছাড় দিবে না একচুলও। ১৪ দলের অধিনায়করা একসারিতে আনন্দে ভাসলেও তারা লড়বেন, নিজেদের জন্য, নিজের দেশের জন্য। কারণ, জয় করতে হবে বিশ্বকাপ।
এবার কে জিতিবে বিশ্বকাপ? এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। শক্তির বিচারে বলতে গেলে এবারকার আসরে কোন একক ফেভারিট নাই। আছে ফেভারিটস অর্থাৎ কয়েকটি শক্তিশালী দলের সম্ভাবনা। এবারের আসরে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান ডার্কহর্স। উপমহাদেশের মাটিতে শ্রীলংকাও বেশ শক্তিশালী। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দণি আফ্রিকার সম্ভাবনাও অপরিসীম।
উল্লেখ্য যে, ক্রিকেটের সর্বোচ্চ এ আসরটি এবার ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের হিসাবে এটি দশম আসর যাতে অংশ নিচ্ছে ১৪টি দল। ২০০৬ সালে বিশ্বকাপটির দায়িত্ব পাওয়ার সময় পাকিস্তানও ছিল এর অন্যতম যৌথ আয়োজক। কিন্তু ২০০৯ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সফরকারী শ্রীলংকা দলকে বহনকারী বাসে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালালে ৪৯ ম্যাচের এ বিশ্বকাপটির সহআয়োজনের অধিকার তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় ক্রিকেটের বিশ্বসংস্থা আইসিসি। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আটটি, ভারত ২৯টি ও শ্রীলংকা ১২টি খেলার আয়োজন করছে।
কবিতা
আমাদের স্বাধীনতা
আবুল হোসেন আজাদ
এইযে আমার জন্মভূমি
মায়ের মত আপন
এর বুকে তাই সুখে দুখে
আমার জীবন যাপন।
একাত্তরে অস্ত্র হাতে
নিয়েছিলাম তুলে;
করেছিলাম যুদ্ধ ন’মাস
বাঁধা ও ভয় ভুলে।
তাইতো পেলাম স্বাধীনতা
প্রিয় স্বাধীন দেশ;
চোখ জুড়ানো রূপের বাংলাদেশ
শপথ নিলাম আমার দেশের
স্বাধীনতার জন্য-
প্রয়োজনে লড়বো আবার
করবো না কার্পণ্য।
আমার দেশের স্বাধীনতা
দেবোনা ফের কারো
গড়তে এদেশ যার যা কাজে
মন দেবো যে আরো ।
অবাক প্রকৃতি
আবু জাহিদ
কি মনোরম মেদিনী তোমার গড়া
অনেকে লিখেছে গান, কবিতা, ছড়া।
রম্য গগন তোমারি সৃজন,
সকল সৃষ্টিই করে তার তর্জন
অকান্ত শৈবালিনী চলে বহমান
তারই দয়াই শশী,বানু নিত্য চলমান
পয়োধির মাঝে আছে অনেক জীবের নাশ
জলধারার গর্জনে মেতে উঠে গগন
তারই মাঝে কখনও জ্বলে উঠে পবন।
পশ্চিম গগনে অস্তিমিত যখন তপন,
এই ধরণীর সবাই সবার যেন আপন
রজনীতে উদিত হয় যখন শশী
প্রকৃতির চারু তখনি হয় বেশি।
পাহাড় পর্বতে গেটে আছে ভূমি,
বৃষ্টিতে জলধরা করে তার শিরচুমি।
সব কিছুতেই বিদ্যমান স্রষ্টার পরিচয়!
সেই স্রষ্টার পরিচয় জানেই বা কয়জন।
শাপলা ফুলের কলি
নূর মোহাম্মদ
আকাশ ভরা গ্রহ তারা,
বিশ্ব ভরা দেশ
রূপে রসে গন্ধে ভরা
মোদের বাংলাদেশ।
সকল দেশের ফলের চেয়ে
কাঁঠাল সবার বড়;
সে তো মোদের জাতীয় ফল
গর্ব সবাই করো ।
পাহাড় নদী মাঠ পেরিয়ে,
সবুজ রঙের মেলা
হরেক রকম ফুলের সুভাষ
প্রজাপতির খেলা।
ভোর-বিহানে দোয়েল পাখি
শীষ দিয়ে যায় যখন
কৃষক জেলে আপন মনে
কাজে নামে তখন।
গ্রাম বাংলা নদীর জলে
বাংলাদেশের শান
বৈঠা ভাঙ্গা পানির হাসি
মাঝির কন্ঠে গান।
এ দেশেতেই জন্ম আমায়
গর্ব করে বলি;
এ হৃদয়ে ফুটে যখন
শাপলা ফুলের কলি।
সপ্নপুরী
সাবিনা আকতার সুমা
ছোট্ট একটা দ্বীপের মাঝে আমার ছোট বাড়ি,
সুখ দু:খের দিনগুলোকে নিত্য যে দেই পাড়ি,
জল তরঙ্গের সমুদ্রটা হারায় অচিনপুরে,
মাল্লামাঝি নৌকা নিয়ে যায়যে অনেক দূরে।
কয়েকজনে পাল্লা দিয়ে দাড়ের নৌকা টানে,
কেহ আবার মনটা মাতায় হরেক সুরের গানে।
ছোট্ট্র ছেলে মনের সুখে পাতার বাশি বাজায়,
কুমার বাড়ি মাটির হাড়ি রং বেরঙ্গে সাজায়।
পানির বুকে রাজহাসেরা টেউয়ের তালে ভাসে,
ঘাসের ডগায় ভোরের শিশির মুক্তা হয়ে হাসে।
আকাশ মাঝে তপ্ত সূর্য দেখায় খুশির খেলা,
আকাশ জুড়ে নৃত্য করে কাটায় সারা বেলা।
সন্ধাবেলা সূয্যি মামা পূব আকাশে ঢলে,
তখন সবার ঘরে ঘরে সন্ধাবাতি জ্বলে।
গভীর রাতে
(মরহুম বাবার স্মরণে)
সাফা ইসলাম
গভীর রাতে মুগ্ধ করা তারা পানে চেয়ে
কষ্টে আমার অশ্র“ুধারা ঝরে দু’গাল বেয়ে।
বাবার কথা পড়লে মনে আঁধারে ঢেকে যায়
শ্রাবণের বারিধারা যেন হৃদয়কে কাঁদায়।
বাবা আমার চলে গেছেন অনেক অনেক দূরে
তাঁর স্মৃতি আগলে বুকে রাখি যতন করে।
হৃদয়ে সব ভালবাসা শুধুই যে তাঁর তরে,
যতই দূরে থাকোনা তুমি, আছ হৃদয় ঘরে।
ছোট্ট থেকে এই অবধি বুকের গহীন কোণে
ভালবাসার ঠাই দিয়েছ নিত্য সংগোপনে।
জানি আমি, যতই দূরে থাকোনা কেন তুমি
তোমার শুভ কামনা কবরে আমায় চুমি।
তাইতো আমি প্রভূর কাছে তুলে দু’টি হাত
তোমার জন্য প্রতি রাতে চাই যে মাগফিরাত।
প্রতিজ্ঞা
রফিকুল ইসলাম
জন্ম আমার স্বাধীন দেশে
স্বাধীনভাবেই চলতে চাই
এদেশেতে নিত্য কেন
সন্ত্রাসীদের হচ্ছে ঠাই?
দিন দুপুরে মা বোনদের
করছে কত নির্যাতন
আমরা কিশোর সাধু সেজে
রইবো কেবল অচেতন?
না, না, না এ হবেনা
কিশোর মনের প্রতিজ্ঞা
বাহুবলে সব দূর করিব
না মানিব নিষেধাজ্ঞা
বজ্র বেগে চলবো এগে
সকল বাধাঁর অন্ত টানি
আপন হাতে মুছে দেব
অভাগাদের দু:খ গ্লানি
প্রেমের পরশ আনব দেশে
দূর করে সব অত্যাচার
হৃদয়পটে লিখে নেব
বাংলা আমার অহংকার।
আবুল হোসেন আজাদ
এইযে আমার জন্মভূমি
মায়ের মত আপন
এর বুকে তাই সুখে দুখে
আমার জীবন যাপন।
একাত্তরে অস্ত্র হাতে
নিয়েছিলাম তুলে;
করেছিলাম যুদ্ধ ন’মাস
বাঁধা ও ভয় ভুলে।
তাইতো পেলাম স্বাধীনতা
প্রিয় স্বাধীন দেশ;
চোখ জুড়ানো রূপের বাংলাদেশ
শপথ নিলাম আমার দেশের
স্বাধীনতার জন্য-
প্রয়োজনে লড়বো আবার
করবো না কার্পণ্য।
আমার দেশের স্বাধীনতা
দেবোনা ফের কারো
গড়তে এদেশ যার যা কাজে
মন দেবো যে আরো ।
অবাক প্রকৃতি
আবু জাহিদ
কি মনোরম মেদিনী তোমার গড়া
অনেকে লিখেছে গান, কবিতা, ছড়া।
রম্য গগন তোমারি সৃজন,
সকল সৃষ্টিই করে তার তর্জন
অকান্ত শৈবালিনী চলে বহমান
তারই দয়াই শশী,বানু নিত্য চলমান
পয়োধির মাঝে আছে অনেক জীবের নাশ
জলধারার গর্জনে মেতে উঠে গগন
তারই মাঝে কখনও জ্বলে উঠে পবন।
পশ্চিম গগনে অস্তিমিত যখন তপন,
এই ধরণীর সবাই সবার যেন আপন
রজনীতে উদিত হয় যখন শশী
প্রকৃতির চারু তখনি হয় বেশি।
পাহাড় পর্বতে গেটে আছে ভূমি,
বৃষ্টিতে জলধরা করে তার শিরচুমি।
সব কিছুতেই বিদ্যমান স্রষ্টার পরিচয়!
সেই স্রষ্টার পরিচয় জানেই বা কয়জন।
শাপলা ফুলের কলি
নূর মোহাম্মদ
আকাশ ভরা গ্রহ তারা,
বিশ্ব ভরা দেশ
রূপে রসে গন্ধে ভরা
মোদের বাংলাদেশ।
সকল দেশের ফলের চেয়ে
কাঁঠাল সবার বড়;
সে তো মোদের জাতীয় ফল
গর্ব সবাই করো ।
পাহাড় নদী মাঠ পেরিয়ে,
সবুজ রঙের মেলা
হরেক রকম ফুলের সুভাষ
প্রজাপতির খেলা।
ভোর-বিহানে দোয়েল পাখি
শীষ দিয়ে যায় যখন
কৃষক জেলে আপন মনে
কাজে নামে তখন।
গ্রাম বাংলা নদীর জলে
বাংলাদেশের শান
বৈঠা ভাঙ্গা পানির হাসি
মাঝির কন্ঠে গান।
এ দেশেতেই জন্ম আমায়
গর্ব করে বলি;
এ হৃদয়ে ফুটে যখন
শাপলা ফুলের কলি।
সপ্নপুরী
সাবিনা আকতার সুমা
ছোট্ট একটা দ্বীপের মাঝে আমার ছোট বাড়ি,
সুখ দু:খের দিনগুলোকে নিত্য যে দেই পাড়ি,
জল তরঙ্গের সমুদ্রটা হারায় অচিনপুরে,
মাল্লামাঝি নৌকা নিয়ে যায়যে অনেক দূরে।
কয়েকজনে পাল্লা দিয়ে দাড়ের নৌকা টানে,
কেহ আবার মনটা মাতায় হরেক সুরের গানে।
ছোট্ট্র ছেলে মনের সুখে পাতার বাশি বাজায়,
কুমার বাড়ি মাটির হাড়ি রং বেরঙ্গে সাজায়।
পানির বুকে রাজহাসেরা টেউয়ের তালে ভাসে,
ঘাসের ডগায় ভোরের শিশির মুক্তা হয়ে হাসে।
আকাশ মাঝে তপ্ত সূর্য দেখায় খুশির খেলা,
আকাশ জুড়ে নৃত্য করে কাটায় সারা বেলা।
সন্ধাবেলা সূয্যি মামা পূব আকাশে ঢলে,
তখন সবার ঘরে ঘরে সন্ধাবাতি জ্বলে।
গভীর রাতে
(মরহুম বাবার স্মরণে)
সাফা ইসলাম
গভীর রাতে মুগ্ধ করা তারা পানে চেয়ে
কষ্টে আমার অশ্র“ুধারা ঝরে দু’গাল বেয়ে।
বাবার কথা পড়লে মনে আঁধারে ঢেকে যায়
শ্রাবণের বারিধারা যেন হৃদয়কে কাঁদায়।
বাবা আমার চলে গেছেন অনেক অনেক দূরে
তাঁর স্মৃতি আগলে বুকে রাখি যতন করে।
হৃদয়ে সব ভালবাসা শুধুই যে তাঁর তরে,
যতই দূরে থাকোনা তুমি, আছ হৃদয় ঘরে।
ছোট্ট থেকে এই অবধি বুকের গহীন কোণে
ভালবাসার ঠাই দিয়েছ নিত্য সংগোপনে।
জানি আমি, যতই দূরে থাকোনা কেন তুমি
তোমার শুভ কামনা কবরে আমায় চুমি।
তাইতো আমি প্রভূর কাছে তুলে দু’টি হাত
তোমার জন্য প্রতি রাতে চাই যে মাগফিরাত।
প্রতিজ্ঞা
রফিকুল ইসলাম
জন্ম আমার স্বাধীন দেশে
স্বাধীনভাবেই চলতে চাই
এদেশেতে নিত্য কেন
সন্ত্রাসীদের হচ্ছে ঠাই?
দিন দুপুরে মা বোনদের
করছে কত নির্যাতন
আমরা কিশোর সাধু সেজে
রইবো কেবল অচেতন?
না, না, না এ হবেনা
কিশোর মনের প্রতিজ্ঞা
বাহুবলে সব দূর করিব
না মানিব নিষেধাজ্ঞা
বজ্র বেগে চলবো এগে
সকল বাধাঁর অন্ত টানি
আপন হাতে মুছে দেব
অভাগাদের দু:খ গ্লানি
প্রেমের পরশ আনব দেশে
দূর করে সব অত্যাচার
হৃদয়পটে লিখে নেব
বাংলা আমার অহংকার।
বাদশা মিয়া জুবায়ের হুসাইন
আকাশের দিকে তাকালেন বাদশা মিয়া। ভেবেছিলেন খোলা আকাশ দেখবেন। কিন্তু এই শহরে খোলা আকাশ দেখার আশা করা ডুমুরের ফুল দেখার মতো। প্রতিনিয়ত এক সারি ইটের মাঝে সিমেন্ট-বালির মিশ্রণ ঢেলে আরেক সারি ইট গেঁথে তৈরি হচ্ছে আকাশচুম্বি অট্টালিকা। সেখানে কোথায় আসমানি আকাশের দর্শন?
কারেন্টের তারের ওপর বসে ছিল কয়েকটা কাক। তাদেরই একটার বুঝি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার সময় হলো তখন। ‘টপ’ করে উষ্ণ পদার্থটুকু এসে পড়ল বাদশা মিয়ার কপালের ঠিক মাঝখানটিতে। চুন বর্ণের ওই পদার্থ তখন বেয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে।
ভ্রƒ কুঁচকে ফেললেন বাদশা মিয়া। বাম হাতটা উঠিয়ে নেয়ার আগে একটু অন্যরকম উষ্ণতা অনুভব করলেন এই প্রচন্ড গরমের মধ্যেও। পড়ন্ত বিকেল, কিন্তু গরম কমার নাম নেই।
ভেজা পদার্থটা বাম হাতের আঙুলে লাগিয়ে চোখের সামনে ধরলেন। মুহূর্তে কুঁচকে ফেললেন কপালের চামড়া। বিশ্রি গন্ধ বের হচ্ছে ওটা থেকে। নাকমুখ এমনিতেই কুঁচকে গেল তার। ইচ্ছা করল গলার সমস্ত জোর কণ্ঠনালীতে এনে মনের সমস্ত ঝাল মিটিয়ে গালাগাল করে ওই হতচ্ছাড়া কালো পাখিগুলোকে। কিন্তু কী মনে হতে তা আর করলেন না। হয়তো ভাবলেন, ওরা তো আর আগেপিছে ভেবে কিছু করেনি। ওরা তো জানে না যে এই সাদা পদার্থটুকু দুর্গন্ধ ছড়ায় আর মানব জাতির নাক কুঁচকানোর বিষয়ে পরিণত হয়। তাছাড়া ওরা তো অবুঝ জীব। যেখানে বুঝওয়ালা মানুষই নানা সময়ে নানা অকাজ করে যেগুলো তার দ্বারা সম্পন্ন হওয়া শোভা পায় না, জেনে-শুনে-বুঝেই অপরজনকে কষ্ট দেয়- সেখানে কাক নামের ওই সামান্য পাখি মামুলি এ কাজটা করেছে অর্থাৎ কোথাকার কোন্ বাদশা মিয়ার চার আঙুল সমান কপালটাকে ‘ইয়ে’ করে দিয়েছে, এটা নিয়ে ভাববার সময়ইবা কই?
আশেপাশে টিউবওয়েল খুঁজলেন। নাহ্, নেই। কাগজ খুঁজলেন। তাও পেলেন না। পাশের দেয়ালে কিসের যেন পোস্টার সাঁটা আছে। সেখান থেকে কাগজ ছিঁড়ে নিলেন। হাত ও কপাল মুছে ফেললেন। কিন্তু তাতেও মনে স্বস্তি পাচ্ছেন না। বমি বমি আসছে তার। কাকের ইয়েতে এতো দুর্গন্ধ তা তিনি আগে জানতেন না। আর জানলেও বা কী হতো? না, কিছুই হতো না। তিনি পারতেন না আজকের এই ঘটনাটা এড়াতে। হয়তো পারতেন। কীভাবে? হ্যাঁ পারতের যদি একটা পাজেরো গাড়ি তার থাকত। আর পাজেরো না হলেও অন্তত যদি তারই কলিগ মতিন চৌধুরীর মতো একটা সেকেন্ডহ্যান্ট ট্যাক্সি-কারও থাকত। নাইবা থাকল পাজেরো বা মতিন চৌধুরীর মতো সেকেন্ডহ্যান্ড ট্যাক্সি-কার, বাদশা মিয়া যদি নিদেনপক্ষে একটা রিকশা করে বাড়ি ফিরতে পারতেন তাহলেও এটা এড়াতে পারতেন। সত্যিই কি পারতেন এড়াতে?
বাদশা মিয়া এসব নিয়ে আর ভাবতে চান না। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আসে। দুপুরে আজ কেবল দু’টো সিঙারা দিয়ে লাঞ্চ সেরেছেন তিনি। পেটটা তাই একটু কেমন যেন চিনচিন করছে। বাঁ-পাশটায় কী একটা নড়ে নড়ে উঠছে। বাদশা মিয়া আশঙ্কা করছেন এটা এসিডিটির কারণেই হচ্ছে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ বিষয়টা লক্ষ্য করছেন তিনি। তিনি ঘুণাক্ষরেও কখনো ভাবেননি যে তার কোনোদিন এসিডিটি হবে।
বাদশা মিয়া অফিস করে বাড়ি ফিরছিলেন। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন তিনি। বেতন মিডিয়াম কাসের। তাতে ভালোই চলে যায় তার। কিন্তু জিনিসপত্রের অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধিতে এখন আর তিনি পেরে উঠছেন না। ওদিকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও বেড়ে গেছে। ভালো কোনো স্কুল বা কলেজে পড়াতে গেলেই মাস গেলে একগাদা টাকা গুনতে হচ্ছে। বেতনের সিংহভাগটাই এখন ব্যয় হয়ে যায় ছেলেমেয়েদের পেছনে। ইদানীং আরেকটা বিষয় তাকে প্রচন্ড ভাবে পীড়া দিচ্ছে। তিনি অপাত্রে তার শ্রম-অর্থ ঢালছেন নাতো? বড় হয়ে ছেলেমেয়েগুলো তাকে দেখবে তো? যে হারে পারিবারিক বন্ধন এদেশে ভেঙে পড়ছে, তাতে তার এ আশঙ্কাটা কি একেবারেই অমূলক?
বাদশা মিয়া ভাবেন, বর্তমান সমাজের যাবতীয় অসামাজিক কর্মকান্ডের মূলে এই পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা। এখন যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, না বললেও সবাই একবাক্যে যে বিষয়টির দিকে অঙুলি নির্দেশ করবে, তা হলো ইভটিজিং। বাদশা মিয়া ভাবেন, কোত্থেকে এলো এই নোংরা জিনিসটা? তাদের সময় তো এটা ছিল না। কিংবা থাকলেও সেটা চোখে পড়ার মতো ছিল না। আসলে ইভটিজিং হচ্ছে সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করার একটা কৌশল মাত্র। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণই দেশের তরুণ সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে ওইসব নোংরামির দিকে। যদি পরিবার থেকেই একজন সন্তানকে ঠিকভাবে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা হতো, তাহলে চিত্রটা কেমন হতো? ঠিক তাদের আদর্শপাড়া গ্রামটার মতোÑ ভাবেন বাদশা মিয়া। আর ভাবেন, এখনও এই অবস্থা থেকে হয়তো উত্তরণ সম্ভব, যদি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
আর কত কী সব মাথায় ঢুকে চিন্তাটাকে তালগোল পাকিয়ে দিতে লাগল বাদশা মিয়ার। তাই আর ভাবতে চাইল না। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, এবং এটাই চান, তার সন্তানরা তাকে নিরাশ করবে না। তাদেরকে তিনি সেভাবেই গড়ে তুলছেন ছোটবেলা থেকেই।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বাদশা মিয়া। নিঃশ্বাসের সাথে কেমন গরমের হলকা বের হলো বলে মনে হলো। একটু যেন চমকালেন তাতে। নিজের অজান্তেই ডান হাতটা উঠে গেল কপালে। হাতের কব্জির এপিঠ-ওপিঠ দিয়ে শরীরের তাপ অনুভব করার চেষ্টা করলেন। একটু গরম ঠেকল না? হ্যাঁ, গরমই তো! বাদশা মিয়া বুঝলেন তার জ্বর আসছে। গরমের শরীরে ঘাম জমে ঠান্ডা লেগে গেছে। নাকের মধ্যে কেমন সুরসুর করে উঠল। কয়েক সেকেন্ড পর বিকট শব্দে একটা হাঁচি বেরিয়ে এলো। তারপরই নাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে লাগল।
জ্বরের সাথে সর্দিও শুরু হয়েছে বাদশা মিয়ার।
বাদশা মিয়ার এখন পকেট খালি। যাকে বলে ঐধৎফ ঁঢ় হড়।ি তাই ভয়ানক দুশ্চিন্তাতে ভুগছেন তিনি।
এই একটু আগে ঘটেছে ঘটনাটা।
বেলা চারটা পর্যন্ত অফিস করে সিএনজি করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছিল।
কয়েক বছর ধরে এক জায়গায় কিছু টাকা জমাচ্ছিলেন তিনি। মাঝে বাদ দিয়েছিলেন, মানে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই ওটার কথা আর মনেও ছিল না। আজই ওরা এসে টাকাটা দিয়ে গেছে। সে কারণেই আজ তার আনন্দ লাগছিল আর দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য সিএনজিতে চড়ে বসেছিলেন তিনি।
বাদশা মিয়ার মনের মধ্যে এখন একসাথে অনেকগুলো অপূরণীয় স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্নগুলো দেখে আসছেন তিনি। সেগুলো ক্রমান্বয়ে ডালপালা বিস্তার করতে করতে ছড়িয়ে গেছে সমস্ত দেহের মধ্যে। সেই সকল ডালপালা তিনি এক এক করে ভরে দেবেন, তবে পাতা বা ফুল-ফল দিয়ে নয়, সুপ্ত আশাগুলোকে বাস্তবে রূপ দান করে। সেটাও অবশ্য এক প্রকার সবুজ পত্রপল্লব আর পুষ্প ও ফলাদি দিয়ে ডাল ভরে দেয়ার মতোইÑ ভাবলেন বাদশা মিয়া।
অথচ...
শহরটা এখন বেশ ব্যস্ত। অথচ তিনি যখন প্রথম এসেছিলেন এই শহরে, তাও আজ থেকে প্রায় পাঁচ-সোয়া পাঁচ বছর হবে, তখন শহরটা এত ব্যস্ত ছিল না। বেশ শান্ত আর ছিমছাম ছিল রাস্তাঘাট, অলিগলি। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা না গেলেও এখনকার মতো অনির্দিষ্ট সময় লাগত না। প্রায় প্রতিটা রাস্তার মোড়েই জ্যাম লেগে থাকে। দেখলে মনে হয় একদল পিঁপড়ে চলেছে একজন সঙ্গীর সন্ধান দেয়া কোনো খাদ্য বয়ে বাসায় আনতে, আগামী দিনের সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে। অথবা ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার দৃশ্যের কথা তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় চলেও আসতে পারে।
এমনই এক জ্যামে পড়েছিলেন বাদশা মিয়া।
খোশ মেজাজে মনে মনে পুরনো দিনের একটা বাংলা গান ভাজছিলেন তিনি। তাই খেয়াল করে পারেননি সিএনজি চালক কখন তার মোবাইলে কথা সেরে নিয়েছে।
সবুজ বাতি জ্বলতেই আবার গাড়িগুলো চলতে শুরু করল। কিছু পথ যেয়ে আবারও সিগন্যাল। অবশ্য এবারেরটা তাড়াতাড়িই ছেড়ে গেল। আর একটু পথ যেতেই ঘটল ঘটনাটা, বাদশা মিয়ার জীবনে এই প্রথম...
সিএনজি ড্রাইভার হঠাৎ একটু সেøা করে ফেলল তার সিএনজি। রাস্তার দু’পাশ থেকে হাজির হল আরও জন চারেক লোক। এসে ঘিরে ধরল বাদশা মিয়াসহ তার সিএনজিকে। দু’পাশ থেকে দু’জন উঠেও পড়ল।
ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলেন বাদশা মিয়া। বললেন, ‘এ্যা..এ্যা..এ্যাই, কী চাও তোমরা? গাড়িতে উঠে পড়লে যে! এটা তো আমি ভাড়া করেছি।’ আরও কী সব বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাকে মাঝপথেই থেমে যেতে হলো, বরং বাধ্য হলেন থেমে যেতে। কেননা, তার কথার জবাবে লোকগুলোর একজন ধারালো চকচকে ছুরির ফলা ও একজন পিস্তলের বাট দেখালো তাকে, অত্যন্ত নরমভাবে, অথচ হিংস্রতার সাথে।
ভীষণভাবে চমকে উঠলেন বাদশা মিয়া। তোতলাতে লাগলেন, ‘এ.. এ.. এ.. এ কী! কারা তোমরা? দে.. দে.. দেখ, আ.. আ..মি কিন্তু এসবের দারুণ ভয় পাই!’
ওদের মধ্যে এবার একজন বলে উঠল, ‘তাইলে কোনো কথা না কইয়া যা আছে সব দিয়া দাও তো চান।’
‘মা.. মা.. মানে?’ ঢোক গিললেন বাদশা মিয়া।
পূর্বের জনই বলল আবার, ‘ন্যাকা! কিছু বুঝবার পারছ না, তাই না? বের কর শালা যা আছে।’ পিস্তলের নল নাচালো সে এবার। আর তাতে ‘কোত্’ করে একটা ঢোক গিললেন বাদশা মিয়া।
‘ঠি.. ঠি.. ঠিক আছে, দিচ্ছি সব। আগে ও.. ওগুলো সরিয়ে নাও..।’ বললেন তিনি।
বাদশা মিয়া এরপর উঁকি দিয়ে বাইরে তাকাতে চাইলেন, যদি পুলিশ বা এই জাতীয় কাউকে পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি মুখ বাড়াতে যেতেই চাপাকণ্ঠে গর্জে উঠল লোকটা, ‘কোনো চালাকির চেষ্টা কোরো না মিয়া। জলদি কর।’
নিজের কাছে যা ছিল সব বের করে দিলেন বাদশা মিয়া। বরং বলা যায় লোক দু’টো ছিনিয়ে নিল সব।
সব কিছু নেয়া হয়ে গেছে, যখন ভাবল লোকগুলো, তখন একজন বলল, ‘শালা কোনো গ্যান্জাম করবি না। সোজা চইলা যাবি। একবারও পেছন ফিইরা তাকাবি না। যদি তাকাস্, তইলে কলাম...’ হাতের ছোরাটা বিশেষ ভঙ্গিতে নাচাল।
বাকিটা আর না বললেও বুঝে নিলেন বাদশা মিয়া। তাই দ্রুত নেমে গেলেন সিএনজি থেকে। তারপর গলিপথটা ধরে হাঁটা ধরলেন। অনেক কষ্টে পেছন ফিরে তাকানো থেকে নিজেকে সামলে রাখলেন।
মনটা তার গুড়িয়ে যাচ্ছে অসহ্য বেদনায়। সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন তিনি। কপর্দকশূন্য। সারা দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল। গায়ের বল হারিয়ে ফেলছেন তিনি।
গলিপথটা বাঁক নিতেই আর ধৈর্য ধরতে না পেরে পেছন ফিরে তাকালেন তিনি। না, নেই সিএনজিটা। সেখানেই সেভাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি।
মনে হল বিশাল আকাশটা তার মাথার উপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। টলছেন তিনি। পা দু’টো অসাড় হয়ে আসতে চাইছে। তাল সামলাতে ফুটপাথে বসে পড়লেন। দু’হাত দিয়ে চেপে ধরলেন মাথা। ওখানকার, কপালের দু’পাশের রগ দু’টো দপ্দপ্ করে লাফাচ্ছে। তলপেটের নিচে চিনচিন করে ব্যথা করে উঠল হঠাৎ। সেইসাথে ঘাড়ের পেছনটাতেও মৃদু চিনচিনে ভাব উপলব্ধি করলেন।
‘উহ্!’ আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। তার সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আশা, সমস্ত চাওয়া নিমিষেই গুড়িয়ে গেছে। কতদিন ধরে দেখতে থাকা স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছিল, হঠাৎ করেই সব আবার শেষ হয়ে গেল।
চোখ জোড়া ঝাঁপসা হয়ে আসতে চাইছে। তবে প্রবল মানসিক শক্তির অধিকারী বাদশা মিয়া অবশেষে উঠে দাঁড়ালেন। এভাবে ভেঙে পড়লে তো আর হবে না। তাকে চলতে হবে। তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা পথ চেয়ে আছে।
বাদশা মিয়া প্রবলভাবে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন। যে সৃষ্টিকর্তা তাকে সৃষ্টি করেছেন, এতদিন ধরে একান্ত মেহেরবানী করে বাঁচিয়ে রেখেছেন, সেই সৃষ্টিকর্তা তাকে নিরাশ করতে পারেন নাÑ এ বিশ্বাসটুকু তার আছে। আজ একটু আগে যে ঘটনাটা তার জীবনে ঘটে গেল, তার পেছনেও নিঃসন্দেহে কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। তাই ভাঙতে ভাঙতে ভাঙলেন না বাদশা মিয়া।
চলতে লাগলেন তিনি। চলাই যে এখন তার সম্বল। আর কিছুদূর হাঁটার পর যখন তিনি উপরের দিকে তাকিয়েছেন মাথার উপরের নীল আকাশটা দেখতে পাবার প্রত্যাশায়, তখনই কাকটা প্রাকৃতিক কর্ম সেরে নিয়েছে।
শীত করছে বাদশা মিয়ার খুব। তারমানে জ্বরের বেগ বাড়ছে। এই একটু আগেও তিনি ঘামছিলেন ছিনতাইকারীদের শিকারে পরিণত হওয়ার সময়। এমনকি যখন সিএনজিতে করে আসছিলেন, তখনও। আর এখন তিনি রীতিমতো কাঁপছেন, প্রচন্ড শীত তার সমস্ত দেহকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনও বেশ কিছুটা পথ তাকে যেতে হবে। তাই চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন।
‘আরে বাদশা না? তাইতো, বাদশাই তো। এ্যাই বাদশা?’
থমকে দাঁড়ালেন বাদশা মিয়া। কে তাকে নাম ধরে ডাকে? ‘কে?’ মুখ তুলে তাকালেন তিনি। মুহূর্তে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। অস্ফূটে বলে উঠলেন, ‘আরে রাজা যে!’
রাজা বললেন, ‘হ্যাঁ বন্ধু আমি। তা কী ব্যাপার? তুমি এই অসময়ে হেঁটে কোথায় যাচ্ছ?’
‘বলব সব, আগে চল কোথাও গিয়ে বসি।’ এক্ষণে মনে বেশ বল পাচ্ছেন বাদশা মিয়া।
তারা দু’জন নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে বসে পড়লেন। তারপর বাদশা মিয়া শুরু করলেন একটু আগে ঘটে যাওয়া তার জীবনের তীক্ত অভিজ্ঞতার কথা।
রাজা ও বাদশা দু’জন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। একই স্কুল, একই কলেজ ও ভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন তারা। তারপর রাজা শুরু করেছেন ব্যবসা আর বাদশা প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢুকেছেন। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। মাঝে মাঝে ফোনে আলাপ ছাড়া সরাসরি কথা হয় না বললেই চলে। অনেক দিন পর আজ আবার মিলিত হয়েছেন দু’বন্ধু। কিন্তু একটা বিমর্ষ ভাব বিরাজ করছে। রাজা চাইলেন পরিবেশটা হালকা করতে। কিন্তু বাদশা কিছুতেই হালকা হতে পারছেন না। কিভাবেই বা হবেন?
রাজা বললেন, ‘দোস্ত, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ কর, কাল একবার আমার সাথে দেখা কর। দেখি কী করা যায়।’
‘মানে?’ বাদশা মিয়া কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে রাজার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
‘আরে দোস্ত, বিপদে যদি কাজেই লাগতে না পারলাম তো কিসের বন্ধু, অ্যাঁ?’
‘কিন্তু...’
‘কোনো কিন্তু নয়। এখন বাড়ি যাও। আর শোনো, ভাবিকে কিছু বলার দরকার নেই। পরে আমিই সব বুঝিয়ে বলব। ও.কে?’
‘ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ।’
একটা রিকশা ডেকে তাতে বাদশাকে মিয়াকে উঠিয়ে দিলেন রাজা। তাকে কিছু টাকাও দিয়ে দিলেন।
বাদশা মিয়া রিকশায় করে বাড়ি ফিরে এলেন। হাজার চেষ্টা করেও স্ত্রীর সামনে স্বাভাবিক হতে পারছেন না। তবে তাকে কিছু বুঝতেও দিলেন না। স্ত্রীর কথায় ‘হু-হ্যাঁ’ করে সায় দিয়ে গেলেন শুধু।
বাদশা মিয়া জানেন রাজা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি এবং ভালোভাবে। রাজা যে ব্যবসা করেন তার সম্পর্কে একেবারে সবকিছুই না জানলেও যেটুকু জানেন তাতেই তার প্রকৃতি সম্পর্কে অনুমান করে নিতে পারেন। ভাবছেন তার কাছ থেকে সহযোগিতা নেয়া ঠিক হবে না। আবার নিজের অবস্থা সম্পর্কেও ভাবছেন। তাই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তিনি পারছেন না। দারুণ অস্বস্তিতে ছটফট করছেন। ঘুম আসছে না।
স্ত্রী আয়েশা বানু খেয়াল করলেন বিষয়টা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? অমন করছ কেন?’
‘উঁ! না, কিছু না।’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন বাদশা মিয়া।
‘আমার কাছে লুকাচ্ছ কেন? বল না কি হয়েছে তোমার?’ আয়েশা বানুও নাছোড়বান্দা।
বাদশা মিয়া চুপ রইলেন।
আয়েশা বানু বললেন, ‘অফিসে কিছু হয়েছে?’
‘না।’
‘তবে? তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’
বাদশা মিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না সব তাকে বলা ঠিক হবে কি না। এ জগতে তার স্ত্রীই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, শুভাকাক্সক্ষী, বন্ধু। পরম হিতৈষী, বিপদে ব্যথার গায়ে সুখের পরশ লেপনকারী।
কাজেই তাকে বোধহয় সব বলা যায়।
মনস্থির করে ফেললেন বাদশা মিয়া। পাশ ফিরলেন।
‘বল কী? (!)’ সব শুনে বললেন আয়েশা বানু।
‘এখন আমি কী করব তুমিই বলে দাও। আমি.. আমি...’ কথা হারিয়ে ফেলেন বাদশা মিয়া।
আয়েশা বানুও কিছু বলতে পারেন না খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, ‘যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন যদি তুমি ভেঙে পড়ো তাহলে ছেলেমেয়েদেরকে সান্ত¡না দেবে কে?’
‘কিন্তু আমি তো ওদেরকে কথা দিয়েছি! এখন কী করব?’
একটু ভাবলেন আয়েশা বানু। তারপর বললেন, ‘সে দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দাও। আমিই ওদেরকে বুঝিয়ে বলব।’
‘কী বুঝিয়ে বলবে তুমি?’
‘ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না।’ বললেন আয়েশা বানু।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বাদশা মিয়া। বললেন, ‘যাক, একটা দুঃশ্চিন্তা থেকে আমাকে বাঁচালে। কিন্তু...’
‘আবার কিন্তু কিসের? এখন ঘুমাও। কাল একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু কী ব্যবস্থা করবে তুমি?’
‘আমার উপর তোমার বিশ্বাস নেই?’
‘এ কথা কেন বলছ? তুমি ছাড়া কে আমাকে ভালো বোঝে বল? তুমি পাশে আছো বলেই তো আমি এতটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছি। আমি নিশ্চিন্ত থেকেছি তোমার উপর ভরসা করে।’
‘যাহ্। তুমি একটু বাড়িয়েই বলছ।’
বাদশা মিয়া একটু হালকা হলেন। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন।
রাজার কাছে হাত পাতার ইচ্ছা তারও ছিল না। বাধ্য হয়েই সে কাজ করতে যাচ্ছিলেন তিনি। এক্ষণে মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে ইয়া বড় এক জগদ্দল পাথর নেমে গেছে।
চোখ জোড়া আপনাতেই বুজে এলো তার।
কেমন আছেন ঃ ভাল আছি - জহুরী
আপনি কেমন আছেন ?
- ভাল আছি।
- আপনি কেমন ?
- ভাল।
আমাদের সমাজ জীবনে যে কোন পরিচিতি দু’জনের মধ্যে দেখা সাাৎ ঘটলে সালাম/ আদাবের পর কুশলাদি জিজ্ঞাসা এভাবেই শুরু হয়। দু’জনই ‘ভাল’ আছেন ‘মন্দ’ কেউ নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, সবাই যদি ভালই থাকেন তাহলে মন্দের ছড়াছড়ি কেন? যাদের দেহে ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের জের, পেটে গন্ডগোল,অপুষ্টিতে চর্মসার, সারা দেহে চুলকানি, দশ আঙ্গুলের দশখানা নখের লাংগল মজলিসে বসে যেমন চলে, তেমনি চলে শয়নে স্বপনে। এমন অসুখী ব্যস্ত একজন লোককে তামাশা করে জিজ্ঞাসা করেই দেখুন না, তিনি কেমন আছেন? মনের অজান্তে স্বাভাবিক কন্ঠেই তিনি বলে ফেলবেন, ‘ভাল আছি’। এক ভিুককে অন্য চেনা এক ভিুক যখন জিজ্ঞাসা করে ‘কেমন আছ মিয়া’ ফুড়–ৎ করে জবাব আসে,‘ আল্লাহ ভালই রাখছে’। অভাবের তাড়নায় আর মনের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেজন পাগলের মত শান্তি তালাশ করে দিক থেকে দিগন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তিনিও প্রশ্নের একই উত্তর দেন ‘ভাল আছি’। যিনি ঋণে হাবুডুবু খাচ্ছেন,টেনশনে টেনশনে নিঃশেষ হচ্ছেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলে ঐ একই জাবাব পাওযা যাবে ‘ ভাল আছি’। স্বামী হারা বিধবা স্ত্রী, তার অভুক্ত কংকাল সার সন্তানকে বুকে ধরে অন্য বিধবার কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে বলেন ‘ভাল আছি’। ুধার জ্বালায় যেসব নিরন্নের বুক ফাটা হাহাকার সদা উদগত হচ্ছে, তাদের কন্ঠেও ‘ভাল থাকার’ কথা শুনা যায়। অরণীয় কন্যার বাবা বহু চেষ্টা তদবীর করে কন্যা সম্প্রদানের একটা সুযোগ পেয়েছেন; কিন্তু তাও মোটা অঙ্কের যৌতুকের বিনিময়ে। বিয়ের আর বেশি দিন বাকী নেই, এখনও অর্থের টাকা সব যোগাড় হয়নি। কন্যার বাবা পাগলের মত টাকা সংগ্রহের জন্য চেনা-অচেনা সব জায়গায় ধর্না দিচ্ছেন। দারুণ দুঃশ্চিন্তা। পথে হল পড়শীর সাথে দেখা। পড়শী শুধালেন,কেমন আছ জয়তুনের বাপ? কন্যার বাবা বুক ভরা ব্যথা আর সীমাহীন দুঃশ্চিন্তা নিয়েও কেমন করে যেন জবাব দিয়ে দিলেন ‘ভাল আছি’ ভাই। ও পাড়ার জমির আলী সাহেব দু‘দিন আগে তার কিশোর ছেলেকে কবরে শুইয়ে রেখেছেন। তাকেও দেখলাম একজনের জিজ্ঞাসার জবাবে ‘ভাল থাকার’ কথাই বললেন। অবশ্য পরবর্তী বাক্যে ছেলের তিরোধানের কথাও বলে সজল চোখে পাড়লেন। কারখানার শ্রমিক,মাঠের চাষী, নৌকার মাঝি, কামার, কুমার, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, জজ-ব্যরিস্টার, ছাত্র-শিক, অর্থাৎ সকলের কন্ঠে ভাল থাকার কথা শুনা যায়। মন্দ থাকার কথা প্রথমে বলা যেন রীতি বিরুদ্ধ। সকলেই ভাল আছেন যিনি সর্বদা মন্দ থাকেন তিনিও প্রথম মোলাকাতের সময় প্রথম সম্ভাষণে ‘ভাল থাকেন’। তারপর আস্তে আস্তে শুরু হয় মন্দ থাকার বারমাসী কিসসা কাহিনী। সকল ভাল থাকা লোক উদ্বোধনী বাক্য পর্যন্ত ভাল থাকেন। তারপর ভাল থাকার মুখোশ খসে পড়ে, সকলগোমড় ফাঁস হয়ে যায়।
এত জীবন জ্বালার মধ্যে ভাল থাকার কথা কেন অবলীলাক্রমে বের হয়ে পড়ে সে কথা ভাবতে ভাবতে একদিন রাস্তা ধরে চলছি। সামনে পড়ে গেলেন এক বন্ধু। একই প্রশ্ন
‘তুমি কেমন আছ’? ‘ভালই আছি’ এই দুটি শব্দ বের হয় হয় অবস্থা -কিন্তু ব্রেক করলাম জবাবই দিলাম না, অন্য কিছু একটা বলে কেটে পড়লাম। প্রকৃত পে আমি কি জবাব দিতে পারি বলুন? যদি বলি ভাল আছি, তাহলে মিথ্যা জবাব হয়। কারণ আমি ভাল নেই? বাত রোগ আর হার্টের রোগে ভূগছি। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। এছাড়াও আছে নানা ঝামেলা, নান ভাবনা, কোনটা দেশী আর কোনটা বিদেশী।
এত সবের পর ভাল থাকি কিভাবে? ‘ভাল আছি’ বললেই তো হলো না, ভালো থাকার পরই ‘ভাল আছি’ ঘোষণা করা চলে। সুতরাং ভাল না থেকে ভাল আছি বলা অনুচিত। মিথ্যা কথা মুখে আসেনি। তাই মিথ্যাবাদী হতে চাইনি। কিন্তু সত্য কথাও বললাম না। ‘আমি ভাল নেই’ এই স্পষ্ট কথা এ জন্যে বলেনি যে, আল্লাহ তাতে নারাজ হবেন। অকৃতজ্ঞ হবার ভয়ে সত্য কথাটাও বলিনি। কারণ রোজ কিয়ামতে আল্লাহ যখন বলবেন, তুমি ভাল না মন্দ ছিলে সে ব্যারোমিটারটা তো আমার কাছে, তুমি মন মতলবী স্বার্থপরের মত খেয়ালীকরতে গেলে কেন? ল ল লোকের চেয়ে যে তুমি ভাল আছ তা কি দেখতে পাওনি?
কি যে মুসিবত! সত্য বলাও বিপদ আবার মিথ্যা বলার শাস্তি গুরুতর। সঠিক জবাব দেয়া কঠিন। আমি ভাল আছি না মন্দ আছি তা আমি জানি না । আমার ভাল মন্দ বলার মালিক যেহেতু আমি নই, তাই ভাল মন্দের মাঝামাঝি একটা জবাব দেই। একবার এই মাঝামাঝি জবাব দিতে গিয়ে এক নাছোড়বান্দা বন্ধুর পাল্লায় পড়েছিলাম। কিভাবে বিপদে পড়েছিলাম তা বলছি।
বন্ধু ঃ কেমন আছ?
আমি ঃ বেঁেচ আছি।
- বেঁেচ যে আছ তা তো দেখতেই পাচ্ছি, তোমার বাঁচা-মরার কথা আমি জিজ্ঞাসা করিনি। আমি জানতে চাচ্ছি তুমি কিভাবে আছ?
- কোন একভাবে বেঁচে আছি।
- কোন ভাবে আর বেঁচে আছ। সেই ভাবটা কি?
- দিন কেটে যাচ্ছে একভাবে।
- যেভাবে যাচ্ছে সে ভাবের ধরণ কি?
- ধরণের ধারণা আমার নেই।
ভাল-মন্দ বুঝার যখন মতা আছে তখন ‘ধরণের ধারণা’ কেন থাকবে না?
আমার বন্ধুটি এই ভাবে আমাকে নাচিয়ে ছাড়লো। বাধ্য হয়ে অবশেষে আমাকে বলতেই হলো যে, মহা সুখে মহা আনন্দে, মরণের অপোয় আছি। আমার এই কষা উত্তর শুনে বন্ধুটি আবার জের টানলো। এবার আমি মাফ চেয়ে তার মুখ বন্ধ করলাম।
অন্য এক বন্ধুকে একবার সাধারণ রেওয়াজী জবাব দিয়েও রেহাই পাইনি। ‘ভাল আছি’ জবাব শুনে অবাক হয়ে বলল, তাহলে তুমি সত্যিই ভাল আছ? তুমি যে কত বড় ভাগ্যবান! কেউ যখন এই সংসারে ভাল নেই তখন একা একা তুমি কিভাবে ভাল থাকতে পার- আমাকে একটুখানি খুলে বলনা ভাই। তাকে আমি এই কথা বারবারই বুঝাতে লাগলাম যে, প্রথম কথাতেই তো ‘মন্দ থাকার’ দলিল-দস্তাবেজ পেশ করা যায় না। প্রথম সাাতে আলাপনে বেদনার ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়, তাতে উভয়েরই মন খারাপ হয়ে পড়ে। এছাড়া এতে থাকে স্বার্থপর স্বার্থপর ভাব। এজন্য ভাল আছি বলে প্রশ্নকর্তার মনটাকে খুশি রাখা হয়। কারন আমি যেন ভাল থাকি এটাই তো প্রশ্নকর্তা চান। তিনি যা চান তাই তাকে বলে দেয়া হয়। কিন্তু সর্ব েেত্র এই ফর্মূলা কাজে লাগে না। আমার বন্ধুটিও এই ফর্মূলা মানলো না। বললো সব কথাই বুঝলাম, কিন্তু বন্ধুকে খুশি করার জন্য গোজামিলে ভাল থাকার এই নোংড়া রাজনীতি কেন? ভাবলাম সেও নাছোড়বান্দা। তাই একটুখানি মেজাজ দেখিয়ে বললাম, ‘আমি ভাল আছি’ তাই ভাল বলেছি, শত সমস্যার মধ্যে আমার সন্ত্বনা আছে, সমাধান আছে। আমার এই মেজাজী কথায় সে না মানার ভাব-ভঙ্গিমূলক হাসি হেসে চুপ করলো; কিন্তু চুপ হওয়ার আগে অবশ্য বললো ঃ থাক ভাই থাক, তুমি ভালই থাক। ভাল থাকার ব্যাপারটা একটুখানি জটিল বৈকি। ভাল না থেকেও যে ভাল বলা হচ্ছে তাতেই বাধচ্ছে নানা গন্ডগোল। এ দুনিয়াতে এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবে না যার জীবনে কোন সমস্যা বা সংকট নেই। সমস্যা আর সংকটের মধ্যে দিয়ে চলার নামই তো জীবন। কিন্তু সমস্যা আছে বলেই যে সর্বদা প্রকাশ করে বেড়াতে হবে, যার সঙ্গে দেখা হবে তাকে বলতে হবে, ‘আমি ভাল নেই, মন্দ আছি’ এর তো কোন মানে নেই, অর্থ নেই। আমার হাড়িঁর চাল আমাকেই জোগাড় করতে হবে। শূন্য হাড়ি গলায় ঝুলিয়ে দশজনের দৃষ্টি আর্কষণ করা হীনমন্যতা ছাড়া কিছু নয়। আমাকে যা দেয়া হয়েছে হিসাব তারই নেয়া হবে। আমার সমস্যা কিন্তু আমার, সে সমস্যা সাধ্যের সীমানায় সীমিত । সমাধানও সেখানে নিহিত। কোটিপতির বিত্তের প্রতি তাকিয়ে আফসোস করে নিজের কপালে ঠুকর মারার কোন মানে হয় না। কোটিপতির সম্পদের অংশীদারও হবার লোভ যদি থাকে তাহলে কোটিপতির ঝামেলা আর সমস্যার অংশীদারও তো হতে হবে, পারবো কি প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সেই বোঝা বহন করতে?
সুতরাং মোটামোটি হিসাবে যেমন আছি তেমনই ভাল আর সেই ভাল যদি সম্পদের না হয়ে চরিত্রের হয় তাহলে আরও ভাল। ভাল আছি না মন্দ আছি তা বলার দরকার নেই। কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে যদি আলহামদুলিল্লাহ বলা যায় তাহলে নতুন করে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। আমার ভাল মন্দের মালিক যিনি তার হাওলায় নিজেকে সোপর্দ করে দিলে কোন ঝামেলা পোহাতে হয়না। অবশ্য আলহামদুলিল্লাহ যদি প্রাণহীন রেওয়াজে পরিণত হয়, উচ্চারিত পবিত্র কথায় যদি উচ্চারণকারীর ঈমান আমল না থাকে তা’হলে তা হবে আর এক ধররের মোনাফেকী। তবুও আলতু ফালতু কথা বলার চেয়ে এটা বলা অনেক ভাল। একদিন হয়তো তা ঈমানী আমলে পরিণত হতে পারে।
কোন পথকে অবলম্বন করবেন তা ভেবে চিন্তে দেখবেন, তবে যেমনই থাকুক না কেন ভাল না থাকার ব্যাপারে মিথ্যা মোনাফেকীর আশ্রয় যেন কেউ না নেই। সকল ভাল মন্দ সর্বশক্তিমানের উপর ছেড়ে দিয়ে জবাবটা দিলে নিজের কোন ঝামেলা থাকে না।
এবার সকলের কাছে আমার প্রশ্ন -
-কেমন আছেন? ##
জাতীয় সংসদকে উপো করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ ‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘ধর্ম নিরেপতা’ রেখে জাতির সাথে প্রতারণা - হাসান ফেরদৌস
বিশ্বকাপ ক্রিকেট উম্মাদনায় যখন সারাদেশের মানুষ মেতে ওঠেছে। ঠিক সেই সময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে পরিচিত সংবিধান নিয়ে জাতির সাথে প্রতারণা করেছে সরকার। ষোল কোটি মানুষকে ধোঁকা দিয়ে একটি জাল সংবিধান পুনমুদ্রণ যথেষ্ট সংকীর্ণ ও হঠকারীতার পরিচয় দিয়েছে। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে নেওয়ার মধ্যে রাজনৈতিক সততা যদি এক আনা থাকে, তাহলে বাকি পনেরো আনাই ছিল অসততা। জাতীয় সংসদকে উপো করে বর্তমান সরকার তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির মাধ্যমে একটি বাকশালী রাষ্ট্র কায়েমের পথে এগোচ্ছে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান নিয়ে আইনমন্ত্রী ও সংবিধান পুনর্মুদ্রণ কমিটির কো-চেয়ারম্যানের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। আইনজ্ঞরা বলছেন, আইন প্রণয়নে এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে জাতীয় সংসদের। এটি সংসদের একচ্ছত্র অধিকার। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়ন করবেন। আমাদের সংবিধানে কি থাকবে আর কি থাকবে না তা আইনপ্রণেতাদের ওপরই নির্ধারণের দায়িত্ব রয়েছে। অন্যদের নয়।
গত ১০ ফেব্র“য়ারি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ স্বারিত পুনর্মুদ্রিত সংবিধান প্রকাশ করা হয়। আইন অনুযায়ি ওই দিন থেকেই পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কার্যকারি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এখনও তা কার্যকর হয়নি। তাহলে দেশবাসী কোন সংবিধান মেনে চলবে। রাষ্ট্র কোন সংবিধানের ভিত্তিতে চলছে। তাহলে কি দেশে কোন সংবিধান নেই। নাকি কোন বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্টির জন্য আলাদা আলাদা সংবিধান কার্যকর। সরকারের উচিত দেশের ষোল কোটি মানুষের কাছে তা স্পষ্ট করা। প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সর্বোচ্চ পবিত্র আমানত নিয়ে সব রকম খামখেয়ালি বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি অভাবনীয় নৈরাজ্যের ঘূর্ণাবর্তে নিপ্তি হতে পারে। নাগরিকরা আইন অমান্যে আসক্ত হতে পারে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত এবং চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়েছে। এতে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির বিষয়ে প্রধান বিচারপতির যতটুকু মতা ছিল তা অবলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতির হাতে সর্বময় মতা ন্যস্ত করা হয়েছে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এখন বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্তদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের সব কাজ তদারক করবেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণার পর ওই রায়ের আলোকে ১৯৭২-এর সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে সংসদীয় বিশেষ কমিটির সদস্যদের কাছে দেয়া হয়। মুদ্রিত কপি এর বাইরে কাউকে সরবরাহ করা হয়নি।
১৯৭২ সালের সংবিধানে উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে অভিযোগ উত্থাপিত হলে সংসদীয় অভিশংসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা ছিল। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কারণ দর্শানো সাপেে অপসারণের বিধান প্রবর্তন করা হয়। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান প্রবর্তন করা হয়। সুপ্রিম সুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়টিকে নিজের কৃত অপরাধের বিচার নিজেরা করার শামিল বলে অনেকে মন্তব্য করেন। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই বিচারকদের অভিশংসনের বিষয়টি সংসদের হাতে ন্যস্ত। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে এ ব্যাপারে স্পষ্টত কোনো আলোকপাত করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসর-পূর্ববর্তী সব ধরনের লোভ ও মোহের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগের বিধান ছিল না। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী বিচার বিভাগীয় ও আধা বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োগের বিধান প্রবর্তন করা হয়। এতে কোনো বিচারক হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করলে তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি করতে পারবেন বলে বিধান রাখা হয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পদে নিয়োগের বিধান করা হয়। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত রায়ে অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ বিষয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংবিধানের ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অধস্তন আদালতগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাসংক্রান্ত ১৯৭২ সালের সংবিধানে ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকিবে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই মতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকার পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বলা হয়, উপরি উক্ত মতাগুলো রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ এ বিষয়ে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ধারায় ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শের বিধান রহিত করে অধস্তন আদালত বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে চতুর্থ সংশোধনী-পরবর্তী অবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিচার বিভাগের যতটুকু স্বাধীনতা বিদ্যমান ছিল চতুর্থ সংশোধনীর এই ধারা বহাল করার মাধ্যমে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু পুনর্মুদ্রিত এই সংবিধান কার্যকারিতা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে সংবিধান পুনর্মুদ্রণের পর এ বিষয়টি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে অনেকে মনে করেন, সংবিধানে কী থাকবে আর থাকবে না তা নির্ধারণের এখতিয়ার সংসদের। আদালত মতামত দিলেও চূড়ান্তভাবে কার্যকর করার বিষয়টি সংসদেই নির্ধারণ করবে।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক জানান, সংবিধানে বেশি হাত দিতে নেই। এতে জনগণের কোনো কল্যাণ হয় না। আইন প্রণয়নে এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে জাতীয় সংসদের। এটি সংসদের একচ্ছত্র অধিকার। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়ন করবেন। বিচার বিভাগ একটি অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। সংসদ তো আইন প্রণয়নের দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর হস্তান্তর করেননি। আমাদের সংবিধানে কি থাকবে আর কি থাকবে না তা আইনপ্রণেতাদের ওপরই নির্ধারণের দায়িত্ব রয়েছে। অন্যদের নয়।
সুপ্রিম কোর্টে সাবেক রেজিস্ট্রার ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ইকতেদার আহমেদ জানান, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আইন প্রণয়নের েেত্র আইনের খসড়া প্রস্তুত করার পর জনমত যাচাইয়ের জন্য আইন কমিশনের মাধ্যমে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ আয়োজন করা হয়। আইনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণপূর্বক সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করা হয়। আমাদের দেশে ১৯৯৬ সালে আইন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হলেও এই কমিশন কার্যত অকার্যকর রয়েছে। জনমত যাচাই ছাড়া যেকোনো আইন প্রণয়ন করা হলে সে আইন কখনো জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে সম হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল জানান, সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭২ সালে সংবিধান পুনর্মুদ্রণে যে রায় দিয়েছেন এবং সেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কিত যে কথা বলা হয়েছে তা উপো করা হলে সেটি হবে আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ এটি হওয়া উচিত নয়। তারা স্বেচ্ছাচারিতা করেছে। আমি এখনো সংবিধানে পুনর্মুদ্রিত কপি হাতে পাইনি। তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপরই হস্তপে করা হলে এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য যারা সংবিধান পুনর্মুদ্রণের দায়িত্ব আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর অর্পণ করেছিলেন তারাও যে দায়ী তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।
কুহেলি ভেদিয়া জড়তা টুটিয়া এসেছে বসন্তরাজ -অনিমেষ দাস
“হে বসন্ত, হে সুন্দর, ধরনীর ধ্যানভরা ধন, বৎসরের শেষে। শুধু একবার মর্তো মূর্তি ধরো ভুবনমোহন নব বরবেশে!” ধনধান্যে পুষ্পে ভরা এ বসুন্ধরার রূপবৈচিত্র পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। বাংলার প্রকৃতির রূপ, রস গন্ধ অবিরত রং বদলায় । ঋতুবৈচিত্র্যে বাংলার প্রকৃতি সাজে নানান সাজে। অফুরন্ত এরূপ সর্বদা নব নব সাজে সজ্জিত হয়। সুজলা -সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ বৈচিত্রময় দেশ কখনো ভৈরবী রূপ নেয়, কখনো বিুদ্ধ হয়ে ওঠে, কখনো সজল কালো চোখ তুলে ভালোবাসার বান ছুঁড়ে দেয় প্রকৃতির সন্তানদের দিকে। কখনো কিশোরী মেয়েদের মতো বাঁকা চায় , কখনো যৌবন রসে সিক্ত করে সবাইকে। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার অফুরন্ত রূপ কখনো ফুরিয়ে যায় না। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে অন্যতম বৈচিত্রময় দেশ। অফুরন্ত এ রূপ নব নব সাজে সজ্জিত হয়। ছয়টি ঋতু পর্যায়ক্রমে আসে। শীতের বুড়ির কুয়াশার ঘোমটা খুলে প্রকৃতিতে হাজারো ফুলে রং ধরিয়ে দিতে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। ঋতুরাজের আগমনে মৃদুমন্দ দনিা বাতাসের যাদুস্পর্শে বর্ণবিরল পৃথিবীর সর্বাঙ্গে লাগে অপূর্ব পুলক প্রবাহ, বনবীথিরন রিক্ত শাখায় জাগে কচি কিশলয়ের অফুরন্ত উল্লাস। বাতাসের মৃদু মর্মর ধ্বনি এবং দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুগীতি পৃথিবীকে সৃষ্টি করে এক অপরূপ মায়া নিকেতন। অশোক পলাশের রঙিন বিহবলতায় ও শিমুল কৃষ্ণচূড়ায় বিপুল উল্লাসে, মধুমালতী ও মাধবী মঞ্জুরীর উচ্ছল গন্ধমদির প্রবল তায় সারা আকাশ তলে গন্ধ, বর্ণ ও গানের তুমুল কোলাহলে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি। কবির ভাষায়-
কুহেলি ভেদিয়া
জড়তা টুটিয়া
এসেছে বসন্তরাজ।
নবীন আলোকে
নবীন পুলকে
সাজিয়েছে ধরণী আজ।”
শীতে প্রকৃতি রিক্ত হয়। শীত যেন বসন্তের পটভূমি তৈরি করে। নবপত্র সম্ভারে, বর্ণগন্ধময় পুষ্পের সমারোহ, পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আসে ঋতুরাজ বসন্ত। শীত ও গ্রীষ্মের এই সন্ধিকালটি পরম রমনীয়। ফাল্গুনের আগমনে নবপল্লবে সুশোভিত হয় গাছপালা, বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের পুষ্পে সুশোভিত হয়ে ওঠে পৃথিবী। গন্ধ ও বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় কোকিলের কুহুধ্বনি এবং অন্যান্য গায়কী পাখির কন্ঠ। এ যে প্রকৃতির নব যৌবনের প্রতিমূর্তি। ঋতুরাজের যাদুময়ী স্পর্শে গাছপালা তৃনলতায় নতুন নতুন পাতায় সুশোভিত হয়ে ওঠে । আকাশে বাতাসে গোলাপ কিংশুকে আনন্দের শিহরন বয়ে যায়। পৃথিবীতে যেন স্বর্গের সৌন্দর্য নেমে আসে। মানুষের মনে আনন্দ ধরে না। শীতকালে কনকনে শীত সহ্য করতে না পেরে যে মধুকন্ঠ কোকিল লুকিয়ে থাকে তারা আবার ফিরে আসে বসন্তের সময় । পাতার আড়াল থেকে শোনা যায় তাদের সুমধুর গান। বসন্তকালে আম, জাম, লিচু প্রভৃতি গাছে মুকুল ধরে। মুকুলের গন্ধে মৌমাছি ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। এদের গুঞ্জনে চারদিক মুখোরিত হয়ে ওঠে। প্রজাপতি তার রঙিন ডানা মেলে উড়তে থাকে। তখন মৃদুমন্দ দনিা বাতাস বয়ে যায়। সকলের অঙ্গে বুলিয়ে দেয় শান্তির পরশ। প্রকৃতির সারা অঙ্গে যৌবনের ঢেউ খেলে যায় এবং মাটির পৃথিবী নতুন আনন্দে হাসতে থাকে। দিনে সূর্যের আলো এবং রাতে চাঁদের স্নিন্ধ কিরণ পৃথিবীর বুক থেকে শীতের কালিমা দূর করে দেয়। তখন বনে বনে ফোটে শিমুল ,কৃষ্ণচূড়া, অশোক, পলাশ, প্রভৃতি ফুল। তাদের উজ্জল লাল রং সকলের হৃদয় রাজ্যে রঙের পরশ বুলিয়ে দেয়। তাইতো কবি মাইকেল মধুসূধন দত্তের কন্ঠে বসন্তের সৌন্দর্য বর্ণনা শুনি এভাবে
ফুটিল বকুল ফুল কেন লো গোকুলে আজি
কহ না সজলি?
আইল কি ঋতুরাজ? ধরিলা কি ফুলসাজ
বিলাসে ধরণী?
শহুরে জীবনটা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি না থাকায় প্রকৃতির রং ধরার গল্পটা হয়তো শহুরেদের মনে দোলা দেয় না। কিন্তু ই্ট -কাঠ-পাথরের এ-নগর জীবনের একটি ঋতুর জন্য আমরা রাঙিয়ে নেই নিজেকে ফাল্গুনের রংয়ে। বসন্তকে বরণ করে নিতে এই যে উৎসব পহেলা ফাল্গুন আমাদের উৎসাহিত করে। কারণ এর মধ্যে দিয়েই আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে দিয়ে যাই তার শেকড়ের সন্ধান। ফাল্গুনেই ধরা পড়ে এই বাংলার বিস্ময়কর সব সৌন্দর্য। কবির ভাষায়,
“ও আমার বাংলা মা তোর
আকুল করা রূপের শোভায়
হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে।
ফাগুনে তোর কৃষ্ণচূড়ায় পলাশ
বনে কিসের হাসি, চৈতি রাতে
উদাস সুরে রাখাল বাজায় বাঁশের বাঁশি।”
সত্যি বসন্ত অন্য সব ঋতুকে যেন হার মানায়। সেই সঙ্গে সোনাভরা রোদের ঝিলিক যদি আছড়ে পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই। এ ঋতুর রূপময় বৈচিত্র মনের আকাশও যেন রঙিন হয়ে ওঠে। বসন্ত ঋতুকে আরও বর্ণিল করে তোলে বাঙালির বিভিন্ন উৎসব পালন। চারদিক যেন উৎসবে মুখরিত হয়ে থাকে, আর এ উৎসবে প্রাণের আবেগে ছুটে চলে সবাই। পহেলা ফাল্গুন নিয়ে বাঙালির উৎসাহ উদ্দীপনার কোন কমতি নেই। বারো মাসে তেরো পার্বন-কথাটির যথার্থতা রাখতেই বুঝি পহেলা ফাল্গুন উৎসবের আবির্ভাব। কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এই ছোট খাটো উপলদ্ধিগুলোই এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাওয়া যায় নির্মল আনন্দ। আর এ আনন্দ যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে জীবনের সৌন্দর্য সবার চোখে ধরা দেবে। ঋতুরাজ বসন্তের অনুভূতি সম্পর্কে কবি আসাদ চৌধূরী বলেন- “বসন্ত আমার প্রিয় ঋতু। বসন্তের প্রথম দিনে তরুন-তরুনীরা সহ সব বয়সের মানুষ সুন্দর করে সাজে, যা দেখতে ভালো লাগে। বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ি, গায়ে থাকে পাঞ্জাবি ও চাদর।” বসন্তের শীত ও গ্রীষ্মের বিপরীতমুখী আচরণ এক জায়গায় এসে থমকে দাড়াঁয়। তখন থাকে না শীতের হাড়ভাঙা কাঁপুনি আর গ্রীষ্মের মাথা ফাটা উত্তাপ । তাই তখন মনে আসে নতুন উদ্যম আর দেহে আসে নতুন শক্তি এবং সামর্থ। সকলেই শীতের জড়তা কাটিয়ে সতেজ প্রাণ, নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজে লেগে যায়। বসন্তের সৌন্দর্যে সারা দেশকে আন্দোলিত করছে । গ্রামের এই সীমাহীন মাঠ, পথ , ঘাট সর্বত্রই হাওয়ায় কম্পমান । বসন্তে ফিরে আসে প্রতিটি প্রানীর মনে সতেজ অনুভূতি, সতেজ জীবন। শুধু গ্রামে নয় , বি বিধন আর ফ্যাট, কালচারে নি®প্রান প্রায় এই কংক্রিটের জঙ্গল রাজধানীতেও এখন যেটুকু সামান্য সবুজ আছে সেখানে গেলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। বোটানিক্যাল গার্ডেন , রমনা পার্ক, বনানী লেক, ধানমণ্ডি লেক, সোহরাওযাদীউদ্যান, মিন্টু রোড, বলধা গার্ডেন, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গন ফুলে ফুলে উচ্ছল -উজ্জল এখন বাসন্তী হাওয়ায়। এসব এলাকায় কোকিলের কুহুস্বরে মুখর পরিবেশ মন যেন কোন উ দাস লোকে হারিয়ে যেতে চায়। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে বসন্ত জানিয়ে দিয়ে যায় সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা। বসন্তের বানী নতুন কে বরণ করার পুরাতনকে বর্জন করার, ফাল্গুন ও চৈত্র এ দুটি মাস অতি মধুর রূপে সেই বানীকে বসন্তের বীনায় ঝংকৃত করে তোলে।
বসন্তকালে গাছে গাছে নানা রঙের ফুল ফোটে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় প্রকৃতি । সৌরভে আসে অলি, ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখরিত কৃঞ্জবন। প্রকৃতির রূপের নেশায় মানুষ মাতাল হয়ে ওঠে। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়ে থাকে। কবির ভাষায়
“আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।”
ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে বাংলার সবুজ প্রকৃতির অঙ্গন। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে
“ফাগুনে হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
আমার আপন হারায় প্রান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার অশোকে কিংশুকে
অল্েয রঙ লাগল আমার অকারনের সুখে।”
সত্যি সত্যি অকারনে সুখের হাওয়ায় দুলিয়ে দেয় বাঙালির হৃদয় । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের বাউল কবির হৃদয় পর্যন্ত বার বার দুলিতেছে ঋতুরাজ বসন্তে। সে জন্যই বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের সুবাসে মন আনচান করে বাউল কবিরও। সেই মন কেমন করা অনুভবে বাংলার ঋতুরাজের আগমনী দিনে আজ আনন্দের হাট বসেছে রাজধানীসহ সারাদেশের সচেতন অগ্রসর তরুন -তরুনীদের মনে। তাদের যেন কোথাও আর হারিয়ে যেতে নেই মানা। তরুন-তরুনীদের মনে মনে গুঞ্জরিত হবে ভালোলাগার গান, ভালোবাসার গান। তাঁদের হৃদয়ে যেন বাজিতেছে সুরের ধ্বনি।
এই মধুর বসন্ত ঋতুতে ও মানুষ নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কলেরা বসন্ত, টাইফয়েড, প্রভৃতি মারাতœক ব্যাধি আনন্দের মাঝে নিরানন্দের ছায়া পাত করে। তবুও বসন্তের যে বাড়তি সৌন্দর্য ভূলে যাওয়া চলবে না। এখন দনিা মলয় এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় শাড়ির আঁচল তখনি মনে পড়ে সেই শৈশবের কিছু কিছু গান। যা কখনো ভুলবার নয়। তাই যেন মনে পড়ে যায়
“দনিা মলয় ঢেউখেলে যায়-
মনের বাতায়নে’/ শৈশবের কত স্মৃতি
পড়ে যায় মনে।”
শুধু তাই নয়। শীত ও গ্রীষ্মের মাঝখানে অবস্থিত বসন্তকাল মানুষের পে খুবই আরামপ্রদ। প্রানের আরামের সঙ্গে দেহের আরামের অবকাশও এই ঋতুতে তৈরী হয়। নানাবিধ রবি শস্য এবং নানাবিধ রসালো ফলের উপহার দেয় বসন্ত। আর থাকে মলয় বায়ু ফুলের সৌরভ ও কোকিলের কুহুতানে মন জুড়ানো আনন্দ। যখন শাখে শাখে পুষ্প ফোটে, দনিা মলয় ঢেউ খায় পাতায় পাতায়। কোকিলের কুহুকুহু তানে মুখরিত হয়ে উঠে কানন, তখনই সেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে যায়। যখনই মহাসমারোহে বসন্ত তার অপরূপ পরসার ডালি সাজিয়ে প্রকৃতির দ্বারে উপস্থিত হয়, প্রকৃতির পরতে পরতে সৌন্দর্য ঢেউ প্রবাহিত হয়, বাতাবি লেবুর গন্ধে চারদিক সুশোভিত । আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত তখনই সেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে যায়।
কবি সুফিয়া কামালের ভাষায় -
“কুহেলি উত্তরী তালে মাঘের সন্নাসী
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূণ্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে , ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
আবার না পাওয়ার বেদনাও কিন্তু কম নয়। যাইহোক, বসন্ত আসার সাথে সাথে স্রোতস্বিনীর মর্হোমি ছন্দের তালে তালে রুনু ঝুনু রুনু ঝুনু করে বাজতে থাকে। মন চায় নদীর পাড়ে গিয়ে আনমনা হয়ে বসে, বিশুদ্ধ দনিা মলয় গ্রহন করতে। মন চায় সতেজ অনুভূতির নি:শ্বাস ত্যাগ করতে। নদীর সাথে সারাটি ণ বসে মিতালী গড়ে তুলতে ইচ্ছে করে। মনের যত অজানা কথা আছে তা নীরবে নদীর সাথে বলতে ইচ্ছে করে। কবির ভাষায়-
“সারাটি ণ নদীর সনে
বলব কথা যত মনে
কূল কূল নদীর বানে
প্রাণ জুড়াব ঢেউয়ের তানে।”
শীতের ত্যাগের সাধনা বসন্তে সার্থক হয়ে ওঠে । প্রকৃতির সারা অঙ্গে নতুন প্রাণ। নতুন উৎসাহ বসন্ত হয়েছে ঋতুরাজ। বসন্ত মানুষের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি। বসন্ত যে সুন্দর , আর সুন্দর মুখের জয়ই তো সর্বত্র বসন্ত যৌবনের ঋতু, সুন্দরের ঋতু আনন্দের ঋতু। তাই সে ঋতুরাজ। তাই তো
ফুলে ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জনে,
কুহু কুহু কোকিলেরন তানে
মুখরিত ধরনী মন নাহি মানে।
মুষমামন্ডিত স্বর্গের কাল্পনিক সুখের চেয়ে
আনন্দ সুখ বিরাজমান
অনুভূত এখানে।
যুগ যুগ ধরে সুন্দরের পূজারিরা সৌন্দর্যের পূজা করে গেছেন। তাই বাঙালি এবং বাঙালিদের আচার আকৃতি -প্রকৃতি প্রভৃতি বলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেত হয়। বসন্তের সৌন্দর্যের মতে প্রতিটি মানুষের জীবন আনন্দ উল্লাসে ভরে উঠুক সেই আশাই কামনা করি।
লেখক : শিার্থী
গলাচিপা ডিগ্রি কলেজ
গলাচিপা , পটুয়াখালী।
কুহেলি ভেদিয়া
জড়তা টুটিয়া
এসেছে বসন্তরাজ।
নবীন আলোকে
নবীন পুলকে
সাজিয়েছে ধরণী আজ।”
শীতে প্রকৃতি রিক্ত হয়। শীত যেন বসন্তের পটভূমি তৈরি করে। নবপত্র সম্ভারে, বর্ণগন্ধময় পুষ্পের সমারোহ, পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আসে ঋতুরাজ বসন্ত। শীত ও গ্রীষ্মের এই সন্ধিকালটি পরম রমনীয়। ফাল্গুনের আগমনে নবপল্লবে সুশোভিত হয় গাছপালা, বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের পুষ্পে সুশোভিত হয়ে ওঠে পৃথিবী। গন্ধ ও বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় কোকিলের কুহুধ্বনি এবং অন্যান্য গায়কী পাখির কন্ঠ। এ যে প্রকৃতির নব যৌবনের প্রতিমূর্তি। ঋতুরাজের যাদুময়ী স্পর্শে গাছপালা তৃনলতায় নতুন নতুন পাতায় সুশোভিত হয়ে ওঠে । আকাশে বাতাসে গোলাপ কিংশুকে আনন্দের শিহরন বয়ে যায়। পৃথিবীতে যেন স্বর্গের সৌন্দর্য নেমে আসে। মানুষের মনে আনন্দ ধরে না। শীতকালে কনকনে শীত সহ্য করতে না পেরে যে মধুকন্ঠ কোকিল লুকিয়ে থাকে তারা আবার ফিরে আসে বসন্তের সময় । পাতার আড়াল থেকে শোনা যায় তাদের সুমধুর গান। বসন্তকালে আম, জাম, লিচু প্রভৃতি গাছে মুকুল ধরে। মুকুলের গন্ধে মৌমাছি ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। এদের গুঞ্জনে চারদিক মুখোরিত হয়ে ওঠে। প্রজাপতি তার রঙিন ডানা মেলে উড়তে থাকে। তখন মৃদুমন্দ দনিা বাতাস বয়ে যায়। সকলের অঙ্গে বুলিয়ে দেয় শান্তির পরশ। প্রকৃতির সারা অঙ্গে যৌবনের ঢেউ খেলে যায় এবং মাটির পৃথিবী নতুন আনন্দে হাসতে থাকে। দিনে সূর্যের আলো এবং রাতে চাঁদের স্নিন্ধ কিরণ পৃথিবীর বুক থেকে শীতের কালিমা দূর করে দেয়। তখন বনে বনে ফোটে শিমুল ,কৃষ্ণচূড়া, অশোক, পলাশ, প্রভৃতি ফুল। তাদের উজ্জল লাল রং সকলের হৃদয় রাজ্যে রঙের পরশ বুলিয়ে দেয়। তাইতো কবি মাইকেল মধুসূধন দত্তের কন্ঠে বসন্তের সৌন্দর্য বর্ণনা শুনি এভাবে
ফুটিল বকুল ফুল কেন লো গোকুলে আজি
কহ না সজলি?
আইল কি ঋতুরাজ? ধরিলা কি ফুলসাজ
বিলাসে ধরণী?
শহুরে জীবনটা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি না থাকায় প্রকৃতির রং ধরার গল্পটা হয়তো শহুরেদের মনে দোলা দেয় না। কিন্তু ই্ট -কাঠ-পাথরের এ-নগর জীবনের একটি ঋতুর জন্য আমরা রাঙিয়ে নেই নিজেকে ফাল্গুনের রংয়ে। বসন্তকে বরণ করে নিতে এই যে উৎসব পহেলা ফাল্গুন আমাদের উৎসাহিত করে। কারণ এর মধ্যে দিয়েই আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে দিয়ে যাই তার শেকড়ের সন্ধান। ফাল্গুনেই ধরা পড়ে এই বাংলার বিস্ময়কর সব সৌন্দর্য। কবির ভাষায়,
“ও আমার বাংলা মা তোর
আকুল করা রূপের শোভায়
হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে।
ফাগুনে তোর কৃষ্ণচূড়ায় পলাশ
বনে কিসের হাসি, চৈতি রাতে
উদাস সুরে রাখাল বাজায় বাঁশের বাঁশি।”
সত্যি বসন্ত অন্য সব ঋতুকে যেন হার মানায়। সেই সঙ্গে সোনাভরা রোদের ঝিলিক যদি আছড়ে পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই। এ ঋতুর রূপময় বৈচিত্র মনের আকাশও যেন রঙিন হয়ে ওঠে। বসন্ত ঋতুকে আরও বর্ণিল করে তোলে বাঙালির বিভিন্ন উৎসব পালন। চারদিক যেন উৎসবে মুখরিত হয়ে থাকে, আর এ উৎসবে প্রাণের আবেগে ছুটে চলে সবাই। পহেলা ফাল্গুন নিয়ে বাঙালির উৎসাহ উদ্দীপনার কোন কমতি নেই। বারো মাসে তেরো পার্বন-কথাটির যথার্থতা রাখতেই বুঝি পহেলা ফাল্গুন উৎসবের আবির্ভাব। কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এই ছোট খাটো উপলদ্ধিগুলোই এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাওয়া যায় নির্মল আনন্দ। আর এ আনন্দ যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে জীবনের সৌন্দর্য সবার চোখে ধরা দেবে। ঋতুরাজ বসন্তের অনুভূতি সম্পর্কে কবি আসাদ চৌধূরী বলেন- “বসন্ত আমার প্রিয় ঋতু। বসন্তের প্রথম দিনে তরুন-তরুনীরা সহ সব বয়সের মানুষ সুন্দর করে সাজে, যা দেখতে ভালো লাগে। বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ি, গায়ে থাকে পাঞ্জাবি ও চাদর।” বসন্তের শীত ও গ্রীষ্মের বিপরীতমুখী আচরণ এক জায়গায় এসে থমকে দাড়াঁয়। তখন থাকে না শীতের হাড়ভাঙা কাঁপুনি আর গ্রীষ্মের মাথা ফাটা উত্তাপ । তাই তখন মনে আসে নতুন উদ্যম আর দেহে আসে নতুন শক্তি এবং সামর্থ। সকলেই শীতের জড়তা কাটিয়ে সতেজ প্রাণ, নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজে লেগে যায়। বসন্তের সৌন্দর্যে সারা দেশকে আন্দোলিত করছে । গ্রামের এই সীমাহীন মাঠ, পথ , ঘাট সর্বত্রই হাওয়ায় কম্পমান । বসন্তে ফিরে আসে প্রতিটি প্রানীর মনে সতেজ অনুভূতি, সতেজ জীবন। শুধু গ্রামে নয় , বি বিধন আর ফ্যাট, কালচারে নি®প্রান প্রায় এই কংক্রিটের জঙ্গল রাজধানীতেও এখন যেটুকু সামান্য সবুজ আছে সেখানে গেলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। বোটানিক্যাল গার্ডেন , রমনা পার্ক, বনানী লেক, ধানমণ্ডি লেক, সোহরাওযাদীউদ্যান, মিন্টু রোড, বলধা গার্ডেন, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গন ফুলে ফুলে উচ্ছল -উজ্জল এখন বাসন্তী হাওয়ায়। এসব এলাকায় কোকিলের কুহুস্বরে মুখর পরিবেশ মন যেন কোন উ দাস লোকে হারিয়ে যেতে চায়। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে বসন্ত জানিয়ে দিয়ে যায় সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা। বসন্তের বানী নতুন কে বরণ করার পুরাতনকে বর্জন করার, ফাল্গুন ও চৈত্র এ দুটি মাস অতি মধুর রূপে সেই বানীকে বসন্তের বীনায় ঝংকৃত করে তোলে।
বসন্তকালে গাছে গাছে নানা রঙের ফুল ফোটে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় প্রকৃতি । সৌরভে আসে অলি, ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখরিত কৃঞ্জবন। প্রকৃতির রূপের নেশায় মানুষ মাতাল হয়ে ওঠে। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়ে থাকে। কবির ভাষায়
“আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।”
ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে বাংলার সবুজ প্রকৃতির অঙ্গন। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে
“ফাগুনে হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
আমার আপন হারায় প্রান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার অশোকে কিংশুকে
অল্েয রঙ লাগল আমার অকারনের সুখে।”
সত্যি সত্যি অকারনে সুখের হাওয়ায় দুলিয়ে দেয় বাঙালির হৃদয় । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের বাউল কবির হৃদয় পর্যন্ত বার বার দুলিতেছে ঋতুরাজ বসন্তে। সে জন্যই বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের সুবাসে মন আনচান করে বাউল কবিরও। সেই মন কেমন করা অনুভবে বাংলার ঋতুরাজের আগমনী দিনে আজ আনন্দের হাট বসেছে রাজধানীসহ সারাদেশের সচেতন অগ্রসর তরুন -তরুনীদের মনে। তাদের যেন কোথাও আর হারিয়ে যেতে নেই মানা। তরুন-তরুনীদের মনে মনে গুঞ্জরিত হবে ভালোলাগার গান, ভালোবাসার গান। তাঁদের হৃদয়ে যেন বাজিতেছে সুরের ধ্বনি।
এই মধুর বসন্ত ঋতুতে ও মানুষ নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কলেরা বসন্ত, টাইফয়েড, প্রভৃতি মারাতœক ব্যাধি আনন্দের মাঝে নিরানন্দের ছায়া পাত করে। তবুও বসন্তের যে বাড়তি সৌন্দর্য ভূলে যাওয়া চলবে না। এখন দনিা মলয় এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় শাড়ির আঁচল তখনি মনে পড়ে সেই শৈশবের কিছু কিছু গান। যা কখনো ভুলবার নয়। তাই যেন মনে পড়ে যায়
“দনিা মলয় ঢেউখেলে যায়-
মনের বাতায়নে’/ শৈশবের কত স্মৃতি
পড়ে যায় মনে।”
শুধু তাই নয়। শীত ও গ্রীষ্মের মাঝখানে অবস্থিত বসন্তকাল মানুষের পে খুবই আরামপ্রদ। প্রানের আরামের সঙ্গে দেহের আরামের অবকাশও এই ঋতুতে তৈরী হয়। নানাবিধ রবি শস্য এবং নানাবিধ রসালো ফলের উপহার দেয় বসন্ত। আর থাকে মলয় বায়ু ফুলের সৌরভ ও কোকিলের কুহুতানে মন জুড়ানো আনন্দ। যখন শাখে শাখে পুষ্প ফোটে, দনিা মলয় ঢেউ খায় পাতায় পাতায়। কোকিলের কুহুকুহু তানে মুখরিত হয়ে উঠে কানন, তখনই সেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে যায়। যখনই মহাসমারোহে বসন্ত তার অপরূপ পরসার ডালি সাজিয়ে প্রকৃতির দ্বারে উপস্থিত হয়, প্রকৃতির পরতে পরতে সৌন্দর্য ঢেউ প্রবাহিত হয়, বাতাবি লেবুর গন্ধে চারদিক সুশোভিত । আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত তখনই সেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে যায়।
কবি সুফিয়া কামালের ভাষায় -
“কুহেলি উত্তরী তালে মাঘের সন্নাসী
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূণ্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে , ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
আবার না পাওয়ার বেদনাও কিন্তু কম নয়। যাইহোক, বসন্ত আসার সাথে সাথে স্রোতস্বিনীর মর্হোমি ছন্দের তালে তালে রুনু ঝুনু রুনু ঝুনু করে বাজতে থাকে। মন চায় নদীর পাড়ে গিয়ে আনমনা হয়ে বসে, বিশুদ্ধ দনিা মলয় গ্রহন করতে। মন চায় সতেজ অনুভূতির নি:শ্বাস ত্যাগ করতে। নদীর সাথে সারাটি ণ বসে মিতালী গড়ে তুলতে ইচ্ছে করে। মনের যত অজানা কথা আছে তা নীরবে নদীর সাথে বলতে ইচ্ছে করে। কবির ভাষায়-
“সারাটি ণ নদীর সনে
বলব কথা যত মনে
কূল কূল নদীর বানে
প্রাণ জুড়াব ঢেউয়ের তানে।”
শীতের ত্যাগের সাধনা বসন্তে সার্থক হয়ে ওঠে । প্রকৃতির সারা অঙ্গে নতুন প্রাণ। নতুন উৎসাহ বসন্ত হয়েছে ঋতুরাজ। বসন্ত মানুষের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি। বসন্ত যে সুন্দর , আর সুন্দর মুখের জয়ই তো সর্বত্র বসন্ত যৌবনের ঋতু, সুন্দরের ঋতু আনন্দের ঋতু। তাই সে ঋতুরাজ। তাই তো
ফুলে ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জনে,
কুহু কুহু কোকিলেরন তানে
মুখরিত ধরনী মন নাহি মানে।
মুষমামন্ডিত স্বর্গের কাল্পনিক সুখের চেয়ে
আনন্দ সুখ বিরাজমান
অনুভূত এখানে।
যুগ যুগ ধরে সুন্দরের পূজারিরা সৌন্দর্যের পূজা করে গেছেন। তাই বাঙালি এবং বাঙালিদের আচার আকৃতি -প্রকৃতি প্রভৃতি বলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেত হয়। বসন্তের সৌন্দর্যের মতে প্রতিটি মানুষের জীবন আনন্দ উল্লাসে ভরে উঠুক সেই আশাই কামনা করি।
লেখক : শিার্থী
গলাচিপা ডিগ্রি কলেজ
গলাচিপা , পটুয়াখালী।
বিােভে উত্তাল মধ্যপ্রাচ্য : অশনিসংকেত মুসলিম বিশ্বের জন্য সম্রাট নূর
মধ্যপ্রাচ্যের এখনই সর্তক না হলে অশনি সংকেত দেখা দেবে গোটা মুসলিম দেশগুলোতে। এমনই মন্তব্য করেছেন বিষেশজ্ঞরা। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন দিন দিন প্রবল আকার ধারণ করছে। তিউনিসিয়া ও মিশরের পর এবার বাহরাইন, লিবিয়া এবং ইয়েমেনের বিােভকারীরা মতাসীনদের বিরুদ্ধে রাজপথে বিােভ অব্যাহত রেখেছে। সরকার বিরোধীদের বিােভে উত্তাল মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বাহরাইনে বিােভকারীরা সরকার পতনের ডাক দিয়েছে। তারা বলেছে সরকার গদি না ছাড়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না। অপরদিকে, লিবিয়াতে বিােভ সহিংসতায় কয়েকশ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে বলে জানা গেছে। লিবিয়ায় সেনাবাহিনী বিােভকারীদের ওপর ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। বাহরাইনে সরকার আলোচনার উদ্যোগ নিলেও দাবি না মানলে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বিরোধী দলগুলো। মরক্কোর রাজধানীতেও বিােভ হচ্ছে। মিসরের সেই তাহরির স্কয়ারে আবার জমায়েত হচ্ছে বিােভকারীরা। তিউনিসিয়ায়ও বিােভ থামেনি। মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বের বিপ্লবে
উদ্বুদ্ধ হয়ে এবার চীনেও আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়েছে। তিউনিসিয়া ও মিসরে সফল গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতন হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের বিরাট অংশে লেগেছে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ। লিবিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেন বিােভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। অপরদিকে, মিসরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোকবারকের পতনে বিজয় উল্লাসে মেতেছে জনতা। অন্যদিকে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিউনিসিয়ার পলাতক প্রেসিডেন্ট বেন আলী কোমায় চলে গেছেন। সৌদি আরবের একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। এদিকে লিবিয়া সরকার বিােভে নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতা বন্ধ না করলে তাদেরকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দিয়েছে ওবামা প্রশাসন। লিবিয়া অশান্ত হবার কারণে তেলের দামও বেড়ে গেছে।
দেশে দেশে বিাোভ-সমাবেশ
লিবিয়ায় আন্দোলন : লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি পদত্যাগ না করে প্রয়োজনে শহীদ হবেন বলে ঘোষণা দেয়ার পর দেশটি মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। গাদ্দাফির এক সাক্ষাতে টিভি ভাষণে তার বাহিনীকে বিােভকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপর বিােভকারীদের সাথে সরকারের অনুগত বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। একে গৃহযুদ্ধের আলামত হিসেবে মনে করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং জাতিসংঘ। তবে গাদ্দাফি মতা ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দিলেও তার পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। একের পর এক শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে বিােভকারীদের দখলে। বিশ্বের বহু দেশ এবং জাতিসংঘ সেখানকার হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে। এতে আরো কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন তিনি।
বিােভ দমনে গাদ্দাফি চরমপন্থা অবলম্বনের পরেও রাজধানী ত্রিপোলির দখল নেয়ার জন্য বিােভকারীরা জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, গাদ্দাফির নড়াচড়া এখন কার্যত রাজধানী ত্রিপোলিকেন্দ্রীক হয়ে পড়েছে। বিােভকারীরা দাবি করে, গাদ্দাফিকে পদত্যাগ করতেই হবে। তবে বিােভকারীদের উপর নিজ সমর্থকদের হামলা চালানোর আদেশ দিয়ে পালানোর পথ তিনি নিজেই বন্ধ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে প্রয়োজনে শহীদের মৃত্যু বরণ করবেন। নিজ সমর্থকদের ঘর থেকে বের হয়ে বিােভকারীদের মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছেন গাদ্দাফি। তার দমনাভিযানের হুমকি উপো করে হাজারে হাজারে রাজপথে নামছে আন্দোলকারীরা। এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। গাদ্দাফি মতা থেকে সরে না দাঁড়ানোর কথা জানিয়ে বিােভ দমনের হুমকি দেওয়ার পর আন্দোলন গতি পেয়েছে। একের পর এক শীর্ষ কর্মকর্তা গাদ্দাফির প ত্যাগ করছেন। আন্তর্জাতিক চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন গাদ্দাফি। বেনগাজিতে উৎসব শুরু করেছে বিােভকারীরা। একদিকে বিােভের জোয়ার আর অন্যদিকে গাদ্দাফির দমনাভিযানের হুমকিতে বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কায় লিবিয়ায় নিজ নিজ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
পদত্যাগ করবেন না ঃ এক টেলিভিশন ভাষণে গাদ্দাফি বলেন, শহীদ হব, তবু পদত্যাগ করবো না। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু তেল কোম্পানির ষড়যন্ত্রের কারণে তার বিরুদ্ধে বিােভ হচ্ছে। ভাষণের সময় গাদ্দাফি ােভে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বার বার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলে আঘাত করতে থাকেন। লিবীয় নেতা বলেন, আমি একজন যোদ্ধা। তৃণমূল থেকে আমি বিদ্রোহী গাদ্দাফি হয়েছি। বিােভকারীদের হুশিয়ার করে তিনি বলেন, আমি এখনো আমার সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তি প্রয়োগ করার আদেশ দেইনি। এখনো গুলি চালানোর নির্দেশ দেইনি। যখন সেই আদেশ দিব, তখন কিন্তু সব জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ওহে নারী-পুরুষ তোমরা যারা গাদ্দাফিকে ভালোবাস, সবাই ঘর থেকে বের হয়ে রাজপথ দখলে নাও। ঘর ছেড়ে তাদের আক্রমণ কর। তোমরা বের হয়ে তাদের উপর হামলা চালাও। গাদ্দাফি তরুণদের নিজ নিজ এলাকায় কমিটি গঠন করতে আহ্বান জানান। তার সমর্থকরা যাতে একে অন্যকে চিনতে পারে সেজন্য তিনি হাতে সবুজ ব্যান্ড পরতে বলেন। তিনি নিজেকে যোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, লিবিয়া গৌরব চায়, লিবিয়া গোটা বিশ্বের শীর্ষে উঠতে চায়। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ুন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন এই ভাষণের মাধ্যমে গাদ্দাফি গৃহযুদ্ধকে উসকে দিলেন।
প্রত্যদর্শীদের বিবরণ ঃ ত্রিপোলির বাসিন্দারা জানান, গাদ্দাফির বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছে এবং বন্দুকধারীরা নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করছে। তারা জানান, পার্শ্ববর্তী এলাকার সশস্ত্র আফ্রিকান ভাড়াটে সৈন্য ভর্তি একটি বিমান অবতরণ করেছে। ভাড়াটে সৈন্যরা রাস্তায় যাকে দেখছে তার ওপর গুলি চালাচ্ছে। এতে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে।
প ছাড়ছেন কূটনীতিকরা ঃ বিােভকারীদের ওপর সহিংস দমনাভিযানের প্রতিবাদে গাদ্দাফির সরকারের প ত্যাগ করছেন জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত লিবিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, আরব লীগ, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশের দূতবাসের লিবীয় কূটনীতিকরা হয় পদত্যাগ করেছেন নয়তো গাদ্দাফি সরকারের প ত্যাগ করেছেন। এদিকে তুমুল গণবিােভে লিবীয় নেতা গাদ্দাফির গদির অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। বিােভকারীরা দেশের অন্যতম প্রধান শহর বেনগাজি দখল করার পর রাজধানী ত্রিপোলিতে ব্যাপক বিােভ শুরু করেছে। ুব্ধ আন্দোলনকারীরা পার্লামেন্টের একটি ভবন, একাধিক মন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রীয় টিভি ভবনে আগুণ ধরিয়ে দেয়। আগুনে পুড়িয়ে দেয় রাজপথের বহু সংখ্যক গাড়ি। বিােভকারীরা ব্যাংক এবং সরকারি ভবনের বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুট করেছে। রাজধানীসহ একাধিক শহরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। লিবিয়ায় চলমান বিােভ-সহিংসতার মধ্যে মতা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন গাদ্দাফি ও তার পরিবার। গাদ্দাফি পুত্র ইতিমধ্যে দেশের গৃহযুদ্ধ হতে পারে বলে হুমকি দিয়েছেন। তিনি বিােভকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে বিােভকারীরা তাদের প্রস্তাবে কর্ণপাত করছে না। তাদের একমাত্র দাবি এখন গাদ্দাফির পদত্যাগ। লিবিয়া সরকারের বিােভ দমনাভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। এর বিরুদ্ধে সমুচিত ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিয়েছে তারা। ফলে বাড়তি চাপের মুখে পড়েছে গাদ্দাফি প্রশাসন। ব্যাপক হতাহতের পর লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলী ছাড়তে সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ডাক্তাররা দেশের এ ঘটনাকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। তারা জানান, হাসপাতালে শুধু আহত রোগী আর রোগী। আহতদের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ডাক্তাররা চিকিৎসা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, লিবিয়ার ৪২ বছরের শাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির পদত্যাগ ও দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে বিােভ করছে জনতা। ১৯৬৯ সালে তরুণ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার রাষ্ট্রমতা দখল করেন গাদ্দাফি। তখন থেকে দেশটি শাসন করে আসছেন তিনি। গাদ্দাফি হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের কোনো দেশের শাসকদের অন্যতম এবং লিবিয়ার সবচেয়ে বেশি সময়ের শাসক। বিােভ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেশটিতে ইতিমধ্যেই বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও আল-জাজিরা ওয়েবসাইট।
রাষ্ট্রদূতের পদত্যাগ ঃ এদিকে, বিােভকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ও মুয়াম্মার গাদ্দাফির পদত্যাগের দাবিতে ভারতে নিযুক্ত লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত আলি আল-এসাবি পদত্যাগ করেছেন।
ইয়েমেন গণ আন্দোলন ঃ মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলনের ঢেউয়ের আঘাত চলছে ইয়েমেনেও। ইয়েমেনে প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল সালেহর পদত্যাগের দাবিতে বিােভ শুরু হয়েছ। দেশটিতে সরকারবিরোধী বিােভ-সহিংসতায় নিহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। তাইজে শহরের হুরিয়া (স্বাধীনতা) স্কয়ারে সমবেত বিােভকারীদের উপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় বেশ কয়েকজন বিােভকারী আহত হয়েছে। শহরে শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিােভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ ফাঁকা গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণর চেষ্টা করছে।
মিশরে বিজয় মিছিল ঃ মিসরের সফল গণ অভ্যুত্থান উদযাপন করতে বিজয় মিছিলের আয়োজন করে জনগণ। হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসনাবসান উপলে এ মিছিলে যোগ দেয় হাজার হাজার মানুষ। আন্দোলনের ১৮ দিনের নিহত শতাধিক মানুষকে তারা স্মরণ করে এ বিজয় যাত্রার মধ্য দিয়ে। এ বিজয়কে ব্যর্থ হতে দেয়া হবে না। বিােভকারীদের প্রতি কঠোর হবে মিসরীয় সেনাবাহিনী মিসরে গণআন্দোলনের পর প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতন হবার পর এখনও একটি অংশ বিােভ বন্ধ না করায় কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে সেনাবাহিনী। বিােভকারীদের প্রতি সেনাবাহিনী ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। মিলিটারি কাউন্সিলের প থেকে বলা হয়েছে আর কোনো ধরনের বিােভ কিংবা ধর্মঘট সহ্য করা হবে না। কঠোর হস্তে এসব দমন করা হবে।
তিউনিসিয়া মতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মৃত্যুর মুখে : এদিকে, তিউনিশিয়ার মতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবিদিন বেন আলী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে সৌদি আরবের এক হাসপাতালে কোমায় রয়েছেন। তার পারিবারিক এক বন্ধু এ কথা জানান। সূত্র মতে, স্ট্রোক করার পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তিনি কোমায় চলে যান। তার অবস্থা আশংকাজনক।
চীনেও আন্দোলনের ডাক : আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে চীনেও আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে গণজমায়েতের ডাক দেয়া হয়। সাংহাই, বেইজিংসহ বড় বড় শহরে এই জমায়েতের আয়োজন করা হয়। তবে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং কয়েকজন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করে।
বাহরাইনে বিােভ : বাহরাইনে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। রাজধানী মানামার নিয়ন্ত্রণ এখন সশস্ত্র বাহিনীর হাতে। সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সরকার সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করলেও হাজার হাজার বিােভকারী মানুষের ঢল নামে। হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হয় রাজধানীতে। তারা সরকারবিরোধী ব্যানার নিয়ে রাস্তায় শ্লোগান দেয়।
ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে কয়েকদিন যাবৎ বাহরাইনে বিােভ চলছে।
কয়েকদিনের বিােভের পর সম্প্রতি বাহরাইন সরকার দেশটিতে বিােভ প্রদর্শন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সেনাবাহিনী রাজধানী মানামার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং রাজধানীতে প্রবেশের পথগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে টহল দেয়া শুরু করে। আকাশে হেলিকপ্টার দেখা যায়। কোথাও কোথাও দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে বিােভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হতে দেখা যায়। খবর বিবিসি, রয়টার্স, এপি, এএফপি, সিএনএন।
বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ ও বিােভকারীরা এই দমন-পীড়নকে নিষ্ঠুর কাজ বলে অভিহিত করেছেন। সংখ্যালঘু শিয়াদের প্রধান দলের এক নেতা বলেছেন, সরকারের কর্মকান্ডের প্রতিবাদে ১৮ জন এমপি পদত্যাগ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সবকিছুই আমরা করব, প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দিব। আমরা কার্যকর ও সাংবিধানিক গণতন্ত্র চাই।
নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা ঃ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ায় সরকার বিরোধী বিােভকারীদের ওপর প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর ভয়াবহ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা লিবিয়ায় দ্রুত সহিংসতা বন্ধেরও দাবি করেছে। পনের সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ হামলার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহবানও জানিয়েছে। পরিষদ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও শক্তি প্রয়োগ এবং শান্তিপূর্ণ বিােভকারীদের ওপর দমন পীড়ন বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন ঃ এদিকে লিবিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে পেরু। লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে মতাচ্যুত করতে স্বতস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রক্তয়ী অভিযানের প্রোপটে পেরুই প্রথম দেশ হিসেবে এ ধরনের পদপে নিল। পেরুর প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্সিয়া বলেছেন, জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত লিবিয়ার সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করছে পেরু।
বারাক ওবামার নিন্দা ঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিােভকারীদের প্রতি সংযত আচরণ করার জন্য সব দেশের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বিশেষ করে বাহরাইনের বাদশাহকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে জোরালো সহযোগিতার প্রস্তাব করা ইয়েমেন ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের শত্রুভাবাপন্ন দেশ লিবিয়ায় সরকার বিরোধী বিােভকারীদের ওপর দমনপীড়নেরও নিন্দা জানান। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা সমর্থক এ দেশে স্থিতিশীলতা দেখতে চায়। তিনি তিউনিসিয়া, মিশর, বাহরাইন, লিবিয়া ও ইয়েমেনসহ যে সব দেশে গণ আন্দোলন শুরু হয়েছে এতে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন।
মরক্কোর রাজধানী রাবাতেও হাজার হাজার লোক বিােভ করে। বাদশার কিছু মতা হ্রাসের দাবিতে তারা বিােভ করছে। এদিকে তিউনিসিয়ার রাজধানীতে বিােভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি করে নিরাপত্তা বাহিনী। তারা অন্তর্বতী সরকারের পরিবর্তন চায়। ব্যাপক বিােভের মুখে তিউনিসিয়ায়ই প্রথম সরকার পতন হয়। তবে বাহরাইন, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংগঠন গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল সংগঠিত এ সমস্যা সমাধানে বিশেষ বৈঠক আহ্বান করেছেন।
- সাংবাদিক
উদ্বুদ্ধ হয়ে এবার চীনেও আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়েছে। তিউনিসিয়া ও মিসরে সফল গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতন হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের বিরাট অংশে লেগেছে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ। লিবিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেন বিােভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। অপরদিকে, মিসরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোকবারকের পতনে বিজয় উল্লাসে মেতেছে জনতা। অন্যদিকে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিউনিসিয়ার পলাতক প্রেসিডেন্ট বেন আলী কোমায় চলে গেছেন। সৌদি আরবের একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। এদিকে লিবিয়া সরকার বিােভে নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতা বন্ধ না করলে তাদেরকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দিয়েছে ওবামা প্রশাসন। লিবিয়া অশান্ত হবার কারণে তেলের দামও বেড়ে গেছে।
দেশে দেশে বিাোভ-সমাবেশ
লিবিয়ায় আন্দোলন : লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি পদত্যাগ না করে প্রয়োজনে শহীদ হবেন বলে ঘোষণা দেয়ার পর দেশটি মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। গাদ্দাফির এক সাক্ষাতে টিভি ভাষণে তার বাহিনীকে বিােভকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপর বিােভকারীদের সাথে সরকারের অনুগত বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। একে গৃহযুদ্ধের আলামত হিসেবে মনে করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং জাতিসংঘ। তবে গাদ্দাফি মতা ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দিলেও তার পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। একের পর এক শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে বিােভকারীদের দখলে। বিশ্বের বহু দেশ এবং জাতিসংঘ সেখানকার হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে। এতে আরো কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন তিনি।
বিােভ দমনে গাদ্দাফি চরমপন্থা অবলম্বনের পরেও রাজধানী ত্রিপোলির দখল নেয়ার জন্য বিােভকারীরা জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, গাদ্দাফির নড়াচড়া এখন কার্যত রাজধানী ত্রিপোলিকেন্দ্রীক হয়ে পড়েছে। বিােভকারীরা দাবি করে, গাদ্দাফিকে পদত্যাগ করতেই হবে। তবে বিােভকারীদের উপর নিজ সমর্থকদের হামলা চালানোর আদেশ দিয়ে পালানোর পথ তিনি নিজেই বন্ধ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে প্রয়োজনে শহীদের মৃত্যু বরণ করবেন। নিজ সমর্থকদের ঘর থেকে বের হয়ে বিােভকারীদের মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছেন গাদ্দাফি। তার দমনাভিযানের হুমকি উপো করে হাজারে হাজারে রাজপথে নামছে আন্দোলকারীরা। এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। গাদ্দাফি মতা থেকে সরে না দাঁড়ানোর কথা জানিয়ে বিােভ দমনের হুমকি দেওয়ার পর আন্দোলন গতি পেয়েছে। একের পর এক শীর্ষ কর্মকর্তা গাদ্দাফির প ত্যাগ করছেন। আন্তর্জাতিক চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন গাদ্দাফি। বেনগাজিতে উৎসব শুরু করেছে বিােভকারীরা। একদিকে বিােভের জোয়ার আর অন্যদিকে গাদ্দাফির দমনাভিযানের হুমকিতে বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কায় লিবিয়ায় নিজ নিজ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
পদত্যাগ করবেন না ঃ এক টেলিভিশন ভাষণে গাদ্দাফি বলেন, শহীদ হব, তবু পদত্যাগ করবো না। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু তেল কোম্পানির ষড়যন্ত্রের কারণে তার বিরুদ্ধে বিােভ হচ্ছে। ভাষণের সময় গাদ্দাফি ােভে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বার বার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলে আঘাত করতে থাকেন। লিবীয় নেতা বলেন, আমি একজন যোদ্ধা। তৃণমূল থেকে আমি বিদ্রোহী গাদ্দাফি হয়েছি। বিােভকারীদের হুশিয়ার করে তিনি বলেন, আমি এখনো আমার সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তি প্রয়োগ করার আদেশ দেইনি। এখনো গুলি চালানোর নির্দেশ দেইনি। যখন সেই আদেশ দিব, তখন কিন্তু সব জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ওহে নারী-পুরুষ তোমরা যারা গাদ্দাফিকে ভালোবাস, সবাই ঘর থেকে বের হয়ে রাজপথ দখলে নাও। ঘর ছেড়ে তাদের আক্রমণ কর। তোমরা বের হয়ে তাদের উপর হামলা চালাও। গাদ্দাফি তরুণদের নিজ নিজ এলাকায় কমিটি গঠন করতে আহ্বান জানান। তার সমর্থকরা যাতে একে অন্যকে চিনতে পারে সেজন্য তিনি হাতে সবুজ ব্যান্ড পরতে বলেন। তিনি নিজেকে যোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, লিবিয়া গৌরব চায়, লিবিয়া গোটা বিশ্বের শীর্ষে উঠতে চায়। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ুন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন এই ভাষণের মাধ্যমে গাদ্দাফি গৃহযুদ্ধকে উসকে দিলেন।
প্রত্যদর্শীদের বিবরণ ঃ ত্রিপোলির বাসিন্দারা জানান, গাদ্দাফির বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছে এবং বন্দুকধারীরা নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করছে। তারা জানান, পার্শ্ববর্তী এলাকার সশস্ত্র আফ্রিকান ভাড়াটে সৈন্য ভর্তি একটি বিমান অবতরণ করেছে। ভাড়াটে সৈন্যরা রাস্তায় যাকে দেখছে তার ওপর গুলি চালাচ্ছে। এতে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে।
প ছাড়ছেন কূটনীতিকরা ঃ বিােভকারীদের ওপর সহিংস দমনাভিযানের প্রতিবাদে গাদ্দাফির সরকারের প ত্যাগ করছেন জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত লিবিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, আরব লীগ, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশের দূতবাসের লিবীয় কূটনীতিকরা হয় পদত্যাগ করেছেন নয়তো গাদ্দাফি সরকারের প ত্যাগ করেছেন। এদিকে তুমুল গণবিােভে লিবীয় নেতা গাদ্দাফির গদির অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। বিােভকারীরা দেশের অন্যতম প্রধান শহর বেনগাজি দখল করার পর রাজধানী ত্রিপোলিতে ব্যাপক বিােভ শুরু করেছে। ুব্ধ আন্দোলনকারীরা পার্লামেন্টের একটি ভবন, একাধিক মন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রীয় টিভি ভবনে আগুণ ধরিয়ে দেয়। আগুনে পুড়িয়ে দেয় রাজপথের বহু সংখ্যক গাড়ি। বিােভকারীরা ব্যাংক এবং সরকারি ভবনের বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুট করেছে। রাজধানীসহ একাধিক শহরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। লিবিয়ায় চলমান বিােভ-সহিংসতার মধ্যে মতা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন গাদ্দাফি ও তার পরিবার। গাদ্দাফি পুত্র ইতিমধ্যে দেশের গৃহযুদ্ধ হতে পারে বলে হুমকি দিয়েছেন। তিনি বিােভকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে বিােভকারীরা তাদের প্রস্তাবে কর্ণপাত করছে না। তাদের একমাত্র দাবি এখন গাদ্দাফির পদত্যাগ। লিবিয়া সরকারের বিােভ দমনাভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। এর বিরুদ্ধে সমুচিত ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিয়েছে তারা। ফলে বাড়তি চাপের মুখে পড়েছে গাদ্দাফি প্রশাসন। ব্যাপক হতাহতের পর লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলী ছাড়তে সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ডাক্তাররা দেশের এ ঘটনাকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। তারা জানান, হাসপাতালে শুধু আহত রোগী আর রোগী। আহতদের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ডাক্তাররা চিকিৎসা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, লিবিয়ার ৪২ বছরের শাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির পদত্যাগ ও দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে বিােভ করছে জনতা। ১৯৬৯ সালে তরুণ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার রাষ্ট্রমতা দখল করেন গাদ্দাফি। তখন থেকে দেশটি শাসন করে আসছেন তিনি। গাদ্দাফি হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের কোনো দেশের শাসকদের অন্যতম এবং লিবিয়ার সবচেয়ে বেশি সময়ের শাসক। বিােভ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেশটিতে ইতিমধ্যেই বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও আল-জাজিরা ওয়েবসাইট।
রাষ্ট্রদূতের পদত্যাগ ঃ এদিকে, বিােভকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ও মুয়াম্মার গাদ্দাফির পদত্যাগের দাবিতে ভারতে নিযুক্ত লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত আলি আল-এসাবি পদত্যাগ করেছেন।
ইয়েমেন গণ আন্দোলন ঃ মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলনের ঢেউয়ের আঘাত চলছে ইয়েমেনেও। ইয়েমেনে প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল সালেহর পদত্যাগের দাবিতে বিােভ শুরু হয়েছ। দেশটিতে সরকারবিরোধী বিােভ-সহিংসতায় নিহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। তাইজে শহরের হুরিয়া (স্বাধীনতা) স্কয়ারে সমবেত বিােভকারীদের উপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় বেশ কয়েকজন বিােভকারী আহত হয়েছে। শহরে শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিােভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ ফাঁকা গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণর চেষ্টা করছে।
মিশরে বিজয় মিছিল ঃ মিসরের সফল গণ অভ্যুত্থান উদযাপন করতে বিজয় মিছিলের আয়োজন করে জনগণ। হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসনাবসান উপলে এ মিছিলে যোগ দেয় হাজার হাজার মানুষ। আন্দোলনের ১৮ দিনের নিহত শতাধিক মানুষকে তারা স্মরণ করে এ বিজয় যাত্রার মধ্য দিয়ে। এ বিজয়কে ব্যর্থ হতে দেয়া হবে না। বিােভকারীদের প্রতি কঠোর হবে মিসরীয় সেনাবাহিনী মিসরে গণআন্দোলনের পর প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতন হবার পর এখনও একটি অংশ বিােভ বন্ধ না করায় কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে সেনাবাহিনী। বিােভকারীদের প্রতি সেনাবাহিনী ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। মিলিটারি কাউন্সিলের প থেকে বলা হয়েছে আর কোনো ধরনের বিােভ কিংবা ধর্মঘট সহ্য করা হবে না। কঠোর হস্তে এসব দমন করা হবে।
তিউনিসিয়া মতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মৃত্যুর মুখে : এদিকে, তিউনিশিয়ার মতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবিদিন বেন আলী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে সৌদি আরবের এক হাসপাতালে কোমায় রয়েছেন। তার পারিবারিক এক বন্ধু এ কথা জানান। সূত্র মতে, স্ট্রোক করার পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তিনি কোমায় চলে যান। তার অবস্থা আশংকাজনক।
চীনেও আন্দোলনের ডাক : আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে চীনেও আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে গণজমায়েতের ডাক দেয়া হয়। সাংহাই, বেইজিংসহ বড় বড় শহরে এই জমায়েতের আয়োজন করা হয়। তবে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং কয়েকজন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করে।
বাহরাইনে বিােভ : বাহরাইনে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। রাজধানী মানামার নিয়ন্ত্রণ এখন সশস্ত্র বাহিনীর হাতে। সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সরকার সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করলেও হাজার হাজার বিােভকারী মানুষের ঢল নামে। হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হয় রাজধানীতে। তারা সরকারবিরোধী ব্যানার নিয়ে রাস্তায় শ্লোগান দেয়।
ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে কয়েকদিন যাবৎ বাহরাইনে বিােভ চলছে।
কয়েকদিনের বিােভের পর সম্প্রতি বাহরাইন সরকার দেশটিতে বিােভ প্রদর্শন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সেনাবাহিনী রাজধানী মানামার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং রাজধানীতে প্রবেশের পথগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে টহল দেয়া শুরু করে। আকাশে হেলিকপ্টার দেখা যায়। কোথাও কোথাও দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে বিােভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হতে দেখা যায়। খবর বিবিসি, রয়টার্স, এপি, এএফপি, সিএনএন।
বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ ও বিােভকারীরা এই দমন-পীড়নকে নিষ্ঠুর কাজ বলে অভিহিত করেছেন। সংখ্যালঘু শিয়াদের প্রধান দলের এক নেতা বলেছেন, সরকারের কর্মকান্ডের প্রতিবাদে ১৮ জন এমপি পদত্যাগ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সবকিছুই আমরা করব, প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দিব। আমরা কার্যকর ও সাংবিধানিক গণতন্ত্র চাই।
নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা ঃ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ায় সরকার বিরোধী বিােভকারীদের ওপর প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর ভয়াবহ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা লিবিয়ায় দ্রুত সহিংসতা বন্ধেরও দাবি করেছে। পনের সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ হামলার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহবানও জানিয়েছে। পরিষদ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও শক্তি প্রয়োগ এবং শান্তিপূর্ণ বিােভকারীদের ওপর দমন পীড়ন বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন ঃ এদিকে লিবিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে পেরু। লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে মতাচ্যুত করতে স্বতস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রক্তয়ী অভিযানের প্রোপটে পেরুই প্রথম দেশ হিসেবে এ ধরনের পদপে নিল। পেরুর প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্সিয়া বলেছেন, জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত লিবিয়ার সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করছে পেরু।
বারাক ওবামার নিন্দা ঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিােভকারীদের প্রতি সংযত আচরণ করার জন্য সব দেশের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বিশেষ করে বাহরাইনের বাদশাহকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে জোরালো সহযোগিতার প্রস্তাব করা ইয়েমেন ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের শত্রুভাবাপন্ন দেশ লিবিয়ায় সরকার বিরোধী বিােভকারীদের ওপর দমনপীড়নেরও নিন্দা জানান। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা সমর্থক এ দেশে স্থিতিশীলতা দেখতে চায়। তিনি তিউনিসিয়া, মিশর, বাহরাইন, লিবিয়া ও ইয়েমেনসহ যে সব দেশে গণ আন্দোলন শুরু হয়েছে এতে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন।
মরক্কোর রাজধানী রাবাতেও হাজার হাজার লোক বিােভ করে। বাদশার কিছু মতা হ্রাসের দাবিতে তারা বিােভ করছে। এদিকে তিউনিসিয়ার রাজধানীতে বিােভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি করে নিরাপত্তা বাহিনী। তারা অন্তর্বতী সরকারের পরিবর্তন চায়। ব্যাপক বিােভের মুখে তিউনিসিয়ায়ই প্রথম সরকার পতন হয়। তবে বাহরাইন, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংগঠন গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল সংগঠিত এ সমস্যা সমাধানে বিশেষ বৈঠক আহ্বান করেছেন।
- সাংবাদিক
ভোক্তাদের অধিকার রায় আইনের যথার্থ প্রয়োগ চাই মো: আশরাফ আলী
বর্তমানে আমাদের দেশে দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি একটি বড় সমস্যা হয়ে দড়িয়েছে। দ্রব্য মুল্যবৃদ্ধিও নামে চলছে এক ধরনের প্রতারনার খেলা, কোন ধরনের নিয়ম নীতিকে তোয়াক্কা না করে যে,যার মত মূল্য আদায় করে নিচ্ছে ভোক্তাদের কাছ থেকে। এর ফলে তিগ্রস্থ হচ্ছে সর্বস্থরের মানুষ,তবে তুলুনামুলক বেশি র্দুভোগের শিকার হচ্ছে দিনমুজুর,কৃষক ও নিম্নবৃত্ত সীমিত আয়ের মানুষ। এেেত্র কৃষকরা তিগ্রস্থ হচ্ছে উভয় দিক থেকে, কারন তাদের কোন উৎপাদিত পন্য বিক্রি করার সময় কমদামে বিক্রি করতে হয় এবং ওজনেও তাদের কাছ থেকে নেয়া হয় ৪২ কেজিতে মণ হিসাবে। আবার তারা যখন কিনতে যায় তখন তাদের পর্ন কিনতে হয় চড়া দামে। এই প্রতারিত বা তিগ্রস্ত ভোক্তদের সার্থ রার ল্েয চার দলিয় জোট সরকার আমলে আইন করার উদ্যোগ নেয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আইনটির কাজ এগিয়ে নিলেও বর্তমান সরকারের আমলে জাতীয় সংসদের সর্বচ্চো ফোরামে ৬-ই এপ্রিল ২০০৯ ইং তারিখে আইনটি পাস হয়। যার নাম দেয়া হয় ভোক্তা অধিকার সংরন আইন-২০০৯। কিন্তু আইনটি পাস হওয়ার পর যথার্থ প্রয়োগ না হওয়ায় ভোক্তারা এখনও এর সুফল পায়নি।
আইনটিতে ভোক্তাদের অধিকার বিরোধী কার্যহিসাবে যে সব দিক চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর কয়েকটি নিম্নে দেয়া হলোঃ
এই আইনের ২০(ক) কোন আইন বা বিধির অধীন নিধারিত মুল্য অপো অধিক মুল্যে কোন পন্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় করা বা প্রস্তাব করা;
(খ) অজ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পন্য বা ঔষুধ বিক্রয় বা করিতে প্রস্তাব করা;
(গ) মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ভাবে তিকারক কোন দ্রব্য, কোন খাদ্যপন্যের সহিত যা মিশ্রন কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে উক্ত রূপ দ্রব্যমিশ্রিত কোন পন্য বিক্রায় বা করিতে প্রস্তাব করা;
ঘ) কোন পন্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারনকে প্রভাবিত করা;
(চ) কোন পন্য সরবরাহ বা বিক্রয়ের সময় ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজন অপো কম ওজনে বিক্রয় বা সর্বরাহ করা; ও
(ছ) কোন পন্য বিক্রয় বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কাজে ব্যবহত বাটখারা বা ওজন পরিমাপের যন্ত্র প্রকৃত ওজন অপো অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন কারী হওয়া ইত্যাদি।
এই আইনের ৮ ধারায় বলা আছে যে, ভোক্তা অধিকার সংরন পরিষদ এর কার্য হবে এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে প্রয়োজনীয় বিধান মালা প্রনয়ন ; ভোক্তা অধিকার সর্ম্পকে জনসাধারনকে সচেতন করার ল্েয প্রয়োজনীয় শিা ও প্রচারনা মূলক কার্যক্রম গ্রহন করা ইত্যাদি। কিন্তু এর কোন বাস্তব প্রতিফলন না থাকায় এধরনের যে একটি আইন আছে তা এখনও অনেকই জানে না। ভোক্তা অধিকার সংরন আইনে অভিযুক্ত কয়েকটি অপরাধের শাস্তির বিধান নিম্নে দেয়া হলোঃ
এই আইনের ৪০ ধারা মোতাবেক কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপো অধিক মূল্যে কোন পন্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় করলে বা করার প্রস্তাব তিনি অনুর্ধ্ব এক বৎসর কারাদ›ন্ড,বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
এই আইনের ৪১ ধারা মোতাবেক কোন ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পন্য বা ঔষধ বিক্রয় করলে বা করার প্রস্তাব তিনি অনুর্দ্ধ তিন বৎসর কারাদ›ন্ড, বা অনধিক দুই ল টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
এই আইনের ৪৭ ধারা মোতাবেক কোন পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি দোকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কাজে ব্যবহত বাটখারা বা ওজন পরিমাপ যন্ত্র প্রকৃত অপো অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হলে তিনি অনুর্ধ্ব এক বৎসর কারাদ›ন্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার অর্থদন্ড,বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
আইনে শাস্তির এত কঠোর বিধান থাকা সত্ত্বেও দুর্বল প্রয়োগের কারনে দ্রব্যমুল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর অন্যতম কারন এক শ্রেনীর ব্যবসায়ী অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী। যার ফলে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে সকল চেষ্টা হচ্ছে। এটা আমাদের দেশের একটা কালচারে পরিনত হয়েছে, কোন পণ্যের দাম বাড়লে সেটা বর্হিবিশ্বে কমলেও আমাদের দেশে আর কমে না। প্রতি বৎসর বাজেট পাশের সাথে সাথে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটা হিড়িক পড়ে যায়। এতে দেখা যায় বাজেটে যে পণ্যটির দাম বাড়েনি সেটিও বেশি দামে বিক্রি শুরু হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের এই ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন ও দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ। এেেত্র কিছু ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারের জনপ্রিয়তা কমলেও দেশের বৃহৎ জনসাধারন এতে উপকৃত হবে এবং সরকারের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধিপাবে। কারন দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে না পারলে দেশকে দুঃর্নীতি মুক্ত করার প্রতিশ্র“তির ব্যর্থয় ঘটবে। তাই দেশের বৃহৎ জনসাধানের স্বার্থে এই আইনটির যথাযর্থ প্রয়োগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করা সময়ের দাবী।
লেখক : আইন বিভাগ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়
ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রাম।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)