মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০১১

বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বর্ণিল উদ্বোধন ঃ একটি কাপের জন্য লড়ছে ১৪টি দল -মফিজুর রহমান


ক্রিকেটের মহাযজ্ঞের মহা আয়োজনের সূচনালগ্নে ঐতিহাসিক নগরী ঢাকা বিশ্বকে স্বাগত জানাল দু’হাত প্রসারিত করে। ঢাকা সেই রস-রূপ ফুটিয়ে তুলল পরম লালিত্যে, নান্দন্দিকতায়। দৃশ্যটা অনভ্যস্ত। অভিনবত্বও বটে। রিকশায় বসে আছেন রিকি পন্টিং। কোনটাতে গ্রায়েম স্মিথ, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি কিংবা অ্যান্ড্র- স্ট্রাউস। ঢাকার আদিবাহনে চড়ে একে একে তারা প্রবেশ করলেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। যেন ক্রিকেটের বৈশ্বিক-গৃহপ্রবেশ হল। আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১১-র বর্ণিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এটিই সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং চিত্তাকর্ষক অংশ। গৌরবে-সৌরভে, রঙে-রূপে, আলোয়-আনন্দে মোহনীয় এক সন্ধ্যা আড়াই ঘণ্টা আবেশে বুঁদ করে রাখে ক্রিকেটবিশ্বকে। শিল্প ব্যাংকের ভবনে টানানো বিশাল পর্দায় ভেসে ওঠে যখন ফুটে ওঠে ছয় বলের এক ওভার, চার-ছয় মারার অনুপম দৃশ্য, ক্রিকেট তখন সত্যি যেন বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান ভাষা আন্দোলনের মাসে ভাষা শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে ছয় সপ্তাহের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। সুসজ্জিত ও হাইড্রলিক পদ্ধতির মঞ্চে ইবরার টিপু সহশিল্পীদের নিয়ে গাইলেন স্বাগত সঙ্গীতÑ ‘ও পৃথিবী এবার এসে ঃ বাংলাদেশ নাও চিনে, ও পৃথিবী ঃ তোমায় স্বাগত জানাই এই দিনে। তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান মিলা, কণা, এলিটা, বালাম, হƒদয় খান ও অর্ণব। ৪০ জন যন্ত্রশিল্পী ছিলেন সঙ্গে। এর পরই সেই চমৎকৃত কোলাজÑ ১৪ রিকশায় বসে ১৪ অধিনায়কের প্রবেশ। তাদের প্রত্যেকের পাশে শিশু। সবচেয়ে বেশি তালি পড়ল সাকিবের বেলায়। সবার আগে একটি রিকশা-ভ্যানে ছিল বিশ্বকাপের মাসকট স্টাম্পি। মাঠ প্রদণি শেষে ১৪ অধিনায়ক মঞ্চে দাঁড়ান পাশাপাশি। এরপর সনু নিগমের থিম সঙ্গীতের সঙ্গে চলে আতশবাজির খেলা। অনুষ্ঠানে তিন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ-পর্বে ফুটিয়ে তোলা হয় পলিমাটির আবহমান বাংলার কোমল সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য।
কানাডার জনপ্রিয় পপ গায়ক বহুবার গাওয়া শ্রোতা-জয় করা গান ‘সামার অব সিক্সটি নাইন’ গেয়ে শোনান। সবশেষে বলিউড সুরকারত্রয়ী শংকর-এহসান-লয় থিম সঙ গাইলেনÑ ‘দে ঘুমাকে ঃ’। আতশবাজির রোশনাই ছড়িয়ে শেষ হয় স্মরণীয় সন্ধ্যা। অন্যদিকে নিজেদের আঙিনায় এমন বিরল অনুষ্ঠান দেখা থেকে হাজার হাজার দর্শক বঞ্চিত হয়েছেন আয়োজকদের ঔদাসীন্য ও গাফিলতিতে। টিকিট কেটেও তারা মাঠে ঢুকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের আশপাশে বড় পর্দায় অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা না করায় অনেকে ব্যর্থ-মনোরথে ফিরে যান। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে আতশবাজির আলো দেখিয়ে সান্ত্বনা দেন। এর মাধম্যে পর্দা উঠল দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের। এ সময় আতশবাজির আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয় গোটা এলাকা। এত বড় মাপের ক্রীড়া আয়োজন বাংলাদেশে আগে কখনো হয়নি। সেদিক দিয়ে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সহ-আয়োজক দেশ হিসাবে নতুন ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ২০১১ সালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন আমাদের অভিভূত করেছে। বর্ণিল এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির উপস্থাপন এদেশীয় ক্রিকেটকে নতুন পরিচয় করে দিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুষ্ঠানে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের ক্রিকেটকে দেশে ও দেশের বাইরে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ক্রীড়া আসর দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর শুভ উদ্বোধন বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে প্রত্য করেছে অনন্য-অপূর্ব লাল-সবুজের বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর এমন বড় আনন্দের দিন আর কখনো আসেনি। সার্বিকভাবে ৩০ ল মার্কিন ডলারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি ছিল আবহমান বাংলাসহ উপমহাদেশের স্বকীয় ও গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্মারক।
ইতিহাসের সাী হলেন দেশের কোটি কোটি দর্শক
জনস্রোতের মতো চারদিক থেকে আসছিলেন দর্শক। নারী পুরুষ, ছোট ছেলেমেয়ে কেউ যেন বাদ যাচ্ছিলেন না। বেলা চড়া হওয়ার সাথে সাথে শাহবাগ মোড় থেকে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। মতিঝিল দৈনিক বাংলার মোড় থেকে প্রবেশ পথ বন্ধ করা হয়। জিরো পয়েন্ট ছিল বন্ধ। তারপরও পায়ে হেঁটে টিকিট হাতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দর্শকরা লম্বা লাইন দিয়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার জন্য যে উৎসাহ- উদ্দীপনা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তা ছিল লণীয়।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের চারদিক ঘিরে ছিল দর্শক আর দর্শক। যারা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ম্যাচ দেখার টিকিট পেয়েছিলেন তারা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিট পেয়ে বাড়তি সুযোগ গ্রহণ করেছেন। ১ হাজার, ১০ হাজার, ২০ হাজার টাকা একটি টিকিট মূল্য। টিকিট পাওয়া অভিজাত পরিবার থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য, এইসব ভাগ্যবান দর্শক ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে ইতিহাসের সাী হতে এসেছিলেন।
এদিকে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে অব্যবস্থাপনা ছিল গ্যালারির আসন ব্যবস্থাপনা নিয়েও। দর্শকরা কিভাবে কোথায় যাবে, তার জন্য কোনো ভলান্টিয়ার না থাকায় দর্শকরা স্টেডিয়ামে এসে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। টিকিট হাতে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করেছেন। তারপরও সান্ত্বনা আছে অনেক, আত্মতৃপ্তি আছে অনেক। নিজেদের মাঠে বিশ্বকাপ বলে কথা। যারা টেলিভিশন দেখছেন তারাও খুশি, আবার যারা স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছেন তারাও খুশি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করে ইতিহাসের সাী হলেন বাংলাদেশের কোটি কোটি দর্শক।
বিশ্বকাপে জয় পেতে শুরু করেছে টাইগারা : বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে একদিন, এই বিশ্বাস গেঁথে গেছে ক্রিকেটপ্রেমীদের হƒদয়ে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে হেরে কিছুটা নার্ভাস হয়েছিলো বাংলার টাইগারা। তবে ২য় ম্যাচে স্মরণীয়  জয়ের মাধ্যমে সে নাভার্সভাব কেটে যায়। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা ভুলিয়ে বাংলাদেশকে অবিস্মরণীয় জয় উপহার দিলো টাইগার বোলাররা। দেশের সব ক্রিকেট অনুরাগীকে উৎসবে ভাসিয়ে দেয়ায় শুভেচ্ছা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবাইকে। পুরো ম্যাচ জুড়েই অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে দল। ম্যাচের দ্বিতীয় পর্বে দলীয় নৈপুন্যের নান্দনিক প্রদর্শনী ক্রিকেট অঙ্গনে টাইগারদের গৌরবময় পদচারণার ইঙ্গিত বহন করে। তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। আশা করি, সামনের ম্যাচগুলোয় ২০৫ রানের টার্গেটে জয়লাভ টাইগারদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পাশাপাশি সতর্কও করবে। স্বাগতিক দলের ওপর প্রত্যাশার চাপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে বিশ্বকাপের মতো আসরে ব্যাটসম্যানদের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অমনযোগী ব্যাটিং কাম্য নয়। ১৬ কোটি বাংলাদেশির হাত দু’পাশ থেকে আগলে রাখল একটি আশা। তা হলো বাঙালির বিশ্বকাপের আশা।
কে না চায় বিশ্বকাপ জিততে
আফ্রিদী, সাকিব, রিকি পন্টিং, কুমারা সাঙ্গাকারা, মাহেন্দ্র সিং ধোনি প্রত্যেকের চোখে এখন ভাসছে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সারাদেশে যে উন্মাদনা বইছে, ১৪ দলের অধিনায়কদের নিয়ে আইসিসির মিডিয়া সেশনে সেই উন্মাদনার ছোঁয়া টের পাওয়া গেল আরেকবার। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেই সব দেশকে নেতৃত্ব দেয়া ক্যাপ্টেনদের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো বিশ্বকাপ জেতার অঙ্গীকার। পন্টিং, সাঙ্গাকারা, ধোনিদের সেই প্রতিশ্রুতির সাথে তাল মেলালেন বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক সাকিবও। সাকিবের এমন সাহসী কথা অবশ্য বাকি অধিনায়কদেরও কিছুটা হলেও চমকে দিয়েছে। বিশ্বকাপ না জেতার আফসোস সেই ২৮ বছর ধরে। সবকটি টুর্নামেন্টে ফেভারিট হিসাবে অংশ নিলেও বিশ্বকাপ জেতা হয়নি তাদের। স্বাভাবিকভাবে এবার তাদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান, ভারত বা শ্রীলংকার বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা বেশি, অন্তত ধোনি কিংবা সাঙ্গাকারার কাছে অংকের হিসাবও বেশ সহজ। এই টুর্নামেন্টেও ভালো লড়াইয়ের প্রত্যাশা করছেন স্মিথ যেমন, তেমনি পাকিস্তান অধিনায়ক আফ্রিদিও। কন্ডিশনের সাথে অবশ্য এখনো লড়াই করে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপ একটি, লড়বে ১৪টি দল। সারা দুনিয়া কাঁপানো টুর্নামেন্টে কেউ কোন ছাড় দিবে না, ছাড় দিবে না একচুলও। ১৪ দলের অধিনায়করা একসারিতে আনন্দে ভাসলেও তারা লড়বেন, নিজেদের জন্য, নিজের দেশের জন্য। কারণ, জয় করতে হবে বিশ্বকাপ।
এবার কে জিতিবে বিশ্বকাপ? এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। শক্তির বিচারে বলতে গেলে এবারকার আসরে কোন একক ফেভারিট নাই। আছে ফেভারিটস অর্থাৎ কয়েকটি শক্তিশালী দলের সম্ভাবনা। এবারের আসরে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান ডার্কহর্স। উপমহাদেশের মাটিতে শ্রীলংকাও বেশ শক্তিশালী। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দণি আফ্রিকার সম্ভাবনাও অপরিসীম।
উল্লেখ্য যে, ক্রিকেটের সর্বোচ্চ এ আসরটি এবার ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের হিসাবে এটি দশম আসর যাতে অংশ নিচ্ছে ১৪টি দল। ২০০৬ সালে বিশ্বকাপটির দায়িত্ব পাওয়ার সময় পাকিস্তানও ছিল এর অন্যতম যৌথ আয়োজক। কিন্তু ২০০৯ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সফরকারী শ্রীলংকা দলকে বহনকারী বাসে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালালে ৪৯ ম্যাচের এ বিশ্বকাপটির সহআয়োজনের অধিকার তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় ক্রিকেটের বিশ্বসংস্থা আইসিসি। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আটটি, ভারত ২৯টি ও শ্রীলংকা ১২টি খেলার আয়োজন করছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন