বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরত্ব শৃংখলাও স্বার্বোভৌমত্বতার কথা ভাবলেই মেজর এম,এ জলিলের নাম চলে আসে। মেজর এম.এ জলিল একটি নাম, একটি ইতিহাস। তিনি ছিলেন একাধারে সংগ্রামী দেশপ্রেমিক সহজ সরল ও সাহসী, তেমনি ছিলেন সুশৃংখল ও অদম্য কষ্টসহিষ্ণু একজন সোনার মানুষ। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক সংগঠক অন্যদিকে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সেনা নায়ক। তাই তিনি ছিলেন একজন চৌকস মানুষ। সৈনিক জীবনে তাকে যেমন করেছেন সাহসী সুশৃংখল ও কষ্ট সহিষ্ণু আর মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণে তাকে করেছে আরো লড়াকু। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এ েেত্র তিনি বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হন। আর তিনি সাহসীকতার সাথে কাজ করতে সবসময় বেশি পছন্দ করতে তাই আমৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রামী জীবন তাকে করেছিল অকুতোভয় প্রতিবাদী শোষক ও লুটেরা শাসনের প্রতি দৃঢ় আপোসহীস। অবশেষে আদর্শিক চিন্তাকে পরিবর্তন ও ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন তাকে দিয়েছিল জীবনের চরম পূর্ণতা। তাই তিনি বলেছেন মানুষের অন্তরের অন্ত:স্থলে রয়েছে সত্য ও মুক্তি অনুসন্ধানের আজন্ম পিপাসা। আমার জীবনের ল্য অর্জনে আমি অটল, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা আমার স্বভাব নয়। এটাই একজন মুসলমানের প্রকৃত সিফাত বা গুণ। তিনি জন্মের আগেই এতিম হন। ১৯৪২ সালের ৯ই ফেব্র“য়ারি বরিশালের উজিরপুর থানা সদরে মামার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার সংগ্রাম যেন জন্মের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। জীবনের প্রথমভাগে বিভিন্ন কঠোরতার সম্মুখীন হন। এই পৃথিবীতে তার মায়ের ভালোবাসা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
১৯৬০ সালে স্থানীয় ড.ই. ওহংঃরঃঁঃব থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এ সময় তিনি দুটি উপন্যাস “পথের কাঙ্গাল” ও “রীতি” রচনা করেন। যদিও পরবর্তীতে পান্ডুলিপি ২টি হারিয়ে যায়। ১৯৬১ সালে তিনি ইয়াং ক্যাডেটে ভর্তি হন। পাকিস্তানেও তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে ওহঃবৎসধফরধঃব পাশ করেন এবং কাবুলে সামরিক একাডেমীতে প্রশিণ নেন। ১৯৬৫ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন এবং আর্টিলারিতে যোগদেন। একই বছরে তিনি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে ১২নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালে সামরিক একাডেমি থেকে এৎধঃঁধঃরড়হ অর্জন করেন। পরে তিনি ইতিহাসে এম এ পাশ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি ছুটি নিয়ে অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে আসেন। ২৫ মার্চের কালোরাতে দেশের চেহারাটা পাল্টে যায় এবং ২৬ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল ও পটুয়াখালীকে মুক্ত অঞ্চল হিসেবে বজায় রাখতে সম হয়। ৭ এপ্রিল মেজর জলিল খুলনা রেডিও ষ্টেশন মুক্ত করতে অপারেশন চালান আবার ২১ এপ্রিল অস্ত্র সংগ্রহে সুন্দর বনের পথ ধরে তিনি ভারতে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করে মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৬ ডিসেম্বর স্বদেশ স্বাধীন হয়। ১৮ ডিসেম্বর তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং ২৬ ডিসেম্বর বরিশালের হেমায়েত উদ্দীন খেলার মাঠে তিনি ভাষণ দেন।
সেখানে তাকে সংবর্ধনা দিতে অভূতপূর্ব লোকের সমাগম হয়। স্বাধীনতার পর ভারত স্বদেশকে তাদের একটা প্রদেশ বানাতে চেয়েছিল এবং সেদেশের সেনাবাহিনী এদেশের সম্পদ ও কর্তৃত্ব কেড়ে নিতে চেয়েছিল। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনের পাঁচটি আসনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং নির্বাচনে তার বিজয় ছিল সুনিশ্চিত কিন্তু মতাসীন আওয়ামীলীগ তাকে বিজয়ী হতে দেয়নি।
বলা বাহুল্য রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপ ছিলেন মেজর এম এ জলিল। ১৯৭৪ সালে ১৭ মার্চ স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেড়াও কর্মসূচীতে পুলিশ গুলি করলে জাসদের বহু নেতা নিহত হন।
মেজর জলিল নিজেও হন আহত। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৮ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৩ নভেম্বর আবার গ্রেফতার করা হয়। সাময়িক আদালত কর্ণেল তাহের ও মেজর এম এ জলিল ফাঁসির আদেশ হয় পরে মুক্তি যুদ্ধের বিশেষ অবদানের জন্য মৃত্যুদন্ড মওকূপ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রায় সাড়ে চার বছর কারা ভোগ করার পর ১৯৮০ সালে ২৬ শে মার্চ মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৮২ টাঙ্গাইলের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কন্যা সায়মা আক্তার কে বিয়ে করেন এবং তাদের ঘরে সারাহ ও ফারাহ নামে দু’কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। এদিকে মেজর জলিলের চিন্তা চেতনার ক্রমশ পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ১৯৮৪ সালের ৩ নভেম্বর জাসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “ দলীয় জীবনে জাসদের নেতা কর্মীরা ধর্র্মীয় মূল্যেবোধ প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়েছে। এ বিসর্জন দেওয়ার ফলে নৈতিকতা ও মূল্যেবোধে পরিচালিত মানব দেহ থেকে নিজেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সমাজে বসবাসরত জনগণকে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সংস্কৃতির জীবন এবং মূল্যেবোধ থেকে মোটেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। প্রচলিত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনধারা থেকে কেবল নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখলেই বিকল্প সংস্কৃতির জন্ম নেয় না। বরং এ ধরনের রণকৌশল অবলম্বন সমাজে প্রচলিত নীতি নৈতিকতা আচার অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক মূল্যেবোধের প্রতি তাচ্ছিল্য উপহাস ঘৃণার বহি:প্রকাশ ঘটায় যা প্রকারান্তরে বিপ্লবী আন্দোলনের বিপে চলে যায়।” ইসলাম ধর্ম এদেশের ৯০% গণমানুষের কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসই নয় ইসলাম ধর্মভিত্তিক নীতি-নৈতিকতা আচার অনুষ্ঠান উৎসব পর্ব সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং এ দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রবাহের সাথে ইসলামী আদর্শ অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। জন্ম থেকে শুরু করে জানাজা পর্যন্ত ইসলামের নীতি নির্দেশের আওতায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের জীবন ।
এমন একটি জীবন দর্শনকে অবহেলা উপো কিংবা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে চলার নীতিকে বাস্তবসম্মত কিংবা বিজ্ঞানসম্মত বলা হয় না। প্রগতিশীল আন্দোলনের স্বার্থেই ইসলাম ধর্মের বিজ্ঞান সম্মত মূল্যায়ন অত্যাবশ্যকীয় বলে আমি মনে করি। কারণ ইসলাম শোষণ, জুলুম ,অন্যায়, অসুন্দর সহ সব রকম স্বৈরশাসন এবং মানুষের ওপর প্রভূত্বের ঘোর বিরোধী। ইসলাম পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ রাজতন্ত্র উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ সব মালিকানা একমাত্র আল্লাহরই। মানুষ হচ্ছে তার কেবল প্রয়োজন মেটানোর জন্য আমানাতদার বা কেয়ার টেকার ( তথ্য সূত্র কৈফিয়ত ও কিছু কথা গ্রন্থ)।
সেনা নায়ক মেজর এম এ জলিল এমন কিছু গ্রন্থ লিখে গেছেন যা আমাদের জীবনের সর্বণে দিক নিদের্শনার বাতিঘর। তার রেখা “অরতি স্বাধীনতাই পরাধীনতা”। দেশ প্রেমের বলিষ্ঠ ও উচ্চকিত শ্লোগানের রূপান্তরিত হয়েছে। তার লেখা কয়েকটি বই : সীমাহীন সমর( মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির ডায়েরী), মার্কবাদ ( প্রবন্ধ), সূর্যোদয় (রাজনৈতিক উপন্যাস), কেফিয়াত ও কিছু কথা (প্রবন্ধ), দাবী আন্দোলন দাযিত্ব (প্রবন্ধ), দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন দর্শন (প্রবন্ধ) অরতি স্বাধীনতাই পরাধীনতা (প্রবন্ধ) অংবধৎংয ভড়ৎ ওফবহঃরঃু (ঊধংংধুং) জাসদ থেকে পদত্যাগ করার ১৬দিন পরে তিনি “জাতীয় মুক্তি আন্দোলন” নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই সময় তিনি মরহুম হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে “সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ” গঠনে অংশ নেন। ১৯৮৫ সনের জানুয়ারীতে তাকে গৃহবন্ধী করা হয়। একমাস ছিলেন বন্ধি। সৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারনে ১৯৮৭ সালের ৩০শে ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৮ সালে মার্চ পর্যন্ত সরকার তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আঠক রাখে। এর আগে মেজর এম.এ জলিল লিবিয়া, লেবানন, ইরান, ব্রিটেন ও পাকিস্থানে কয়েকদিন আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালের ১১ নভেম্বর তিনি পাকিস্থানে যান। ১৬ নভেম্বর ইসলামাবাদে তিনি হৃদ রোগে আক্রান্ত হলে সাথে সাথে কিনিকে ভর্তি করা হয়। ১৯ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় এ মহানায়কের যবনিকা ঘটে। ২২নভেম্বর তার মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। সম্পূর্ণ সামররিক মর্যাদায় তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাকে দাফনের মাধ্যমেই মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে লাশ দাপন শুরু হয়। তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক থেকে ইসলামের মহানায়কে পরিণত হতেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন তার সংগ্রামী জীবনকে ইসলামের রঙে রঙিন করতে।
তাই তাকে ইসলাম বিরোধীতাকারীরা সহজে সহ্য করতে পারতেন না। কারণ তার জীবন হয়ে উঠেছিল ইসলামের শানিত তরবারীর ন্যায় গণমানুষের তরে কথা বলার কারণে। তাই তাকে সহ্য করতে হয়েছে বিষেধাগার যন্ত্রনা। আধিপত্যবাধীদের প থেকে তাই বলা যায় তিনি তার জীবনের সকল কর্ম কান্ডের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি কারো কাছে নয়, মহান প্রতি পালকের কাছেই শুধুমাত্র মাথানত করতে জানতেন। বিনম্র শ্রদ্ধাভরে স্মরন করছি এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। কারণ আমাদের কান্তিকালে তাঁরমত জলিলের খুবই দরকার।
লেখক:
শিার্থী, বি.এ (অনার্স) এম,এ (ইংরেজী)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন