মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০১১

জাতীয় সংসদকে উপো করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ ‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘ধর্ম নিরেপতা’ রেখে জাতির সাথে প্রতারণা - হাসান ফেরদৌস




বিশ্বকাপ ক্রিকেট উম্মাদনায় যখন সারাদেশের মানুষ মেতে ওঠেছে। ঠিক সেই সময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে পরিচিত সংবিধান নিয়ে জাতির সাথে প্রতারণা করেছে সরকার। ষোল কোটি মানুষকে ধোঁকা দিয়ে একটি জাল সংবিধান পুনমুদ্রণ যথেষ্ট সংকীর্ণ ও হঠকারীতার পরিচয় দিয়েছে। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে নেওয়ার মধ্যে রাজনৈতিক সততা যদি এক আনা থাকে, তাহলে বাকি পনেরো আনাই ছিল অসততা। জাতীয় সংসদকে উপো করে বর্তমান সরকার তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির মাধ্যমে একটি বাকশালী রাষ্ট্র কায়েমের পথে এগোচ্ছে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান নিয়ে আইনমন্ত্রী ও সংবিধান পুনর্মুদ্রণ কমিটির কো-চেয়ারম্যানের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। আইনজ্ঞরা বলছেন, আইন প্রণয়নে এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে জাতীয় সংসদের। এটি সংসদের একচ্ছত্র অধিকার। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়ন করবেন। আমাদের সংবিধানে কি থাকবে আর কি থাকবে না তা আইনপ্রণেতাদের ওপরই নির্ধারণের দায়িত্ব রয়েছে। অন্যদের নয়।
গত ১০ ফেব্র“য়ারি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ স্বারিত পুনর্মুদ্রিত সংবিধান প্রকাশ করা হয়। আইন অনুযায়ি ওই দিন থেকেই পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কার্যকারি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এখনও তা কার্যকর হয়নি। তাহলে দেশবাসী কোন সংবিধান মেনে চলবে। রাষ্ট্র কোন সংবিধানের ভিত্তিতে চলছে। তাহলে কি দেশে কোন সংবিধান নেই। নাকি কোন বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্টির জন্য আলাদা আলাদা সংবিধান কার্যকর। সরকারের উচিত দেশের ষোল কোটি মানুষের কাছে তা স্পষ্ট করা। প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সর্বোচ্চ পবিত্র আমানত নিয়ে সব রকম খামখেয়ালি বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি অভাবনীয় নৈরাজ্যের ঘূর্ণাবর্তে নিপ্তি হতে পারে। নাগরিকরা আইন অমান্যে আসক্ত হতে পারে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত এবং চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়েছে। এতে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির বিষয়ে প্রধান বিচারপতির যতটুকু মতা ছিল তা অবলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতির হাতে সর্বময় মতা ন্যস্ত করা হয়েছে। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এখন বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্তদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের সব কাজ তদারক করবেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণার পর ওই রায়ের আলোকে ১৯৭২-এর সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে সংসদীয় বিশেষ কমিটির সদস্যদের কাছে দেয়া হয়। মুদ্রিত কপি এর বাইরে কাউকে সরবরাহ করা হয়নি।
১৯৭২ সালের সংবিধানে উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে অভিযোগ উত্থাপিত হলে সংসদীয় অভিশংসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা ছিল। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কারণ দর্শানো সাপেে অপসারণের বিধান প্রবর্তন করা হয়। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান প্রবর্তন করা হয়। সুপ্রিম সুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়টিকে নিজের কৃত অপরাধের বিচার নিজেরা করার শামিল বলে অনেকে মন্তব্য করেন। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই বিচারকদের অভিশংসনের বিষয়টি সংসদের হাতে ন্যস্ত। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে এ ব্যাপারে স্পষ্টত কোনো আলোকপাত করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসর-পূর্ববর্তী সব ধরনের লোভ ও মোহের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগের বিধান ছিল না। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী বিচার বিভাগীয় ও আধা বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োগের বিধান প্রবর্তন করা হয়। এতে কোনো বিচারক হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করলে তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি করতে পারবেন বলে বিধান রাখা হয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পদে নিয়োগের বিধান করা হয়। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত রায়ে অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ বিষয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংবিধানের ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অধস্তন আদালতগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাসংক্রান্ত ১৯৭২ সালের সংবিধানে ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকিবে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই মতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকার পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বলা হয়, উপরি উক্ত মতাগুলো রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ এ বিষয়ে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ধারায় ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শের বিধান রহিত করে অধস্তন আদালত বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে চতুর্থ সংশোধনী-পরবর্তী অবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিচার বিভাগের যতটুকু স্বাধীনতা বিদ্যমান ছিল চতুর্থ সংশোধনীর এই ধারা বহাল করার মাধ্যমে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু পুনর্মুদ্রিত এই সংবিধান কার্যকারিতা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে সংবিধান পুনর্মুদ্রণের পর এ বিষয়টি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে অনেকে মনে করেন, সংবিধানে কী থাকবে আর থাকবে না তা নির্ধারণের এখতিয়ার সংসদের। আদালত মতামত দিলেও চূড়ান্তভাবে কার্যকর করার বিষয়টি সংসদেই নির্ধারণ করবে।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক জানান, সংবিধানে বেশি হাত দিতে নেই। এতে জনগণের কোনো কল্যাণ হয় না। আইন প্রণয়নে এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে জাতীয় সংসদের। এটি সংসদের একচ্ছত্র অধিকার। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়ন করবেন। বিচার বিভাগ একটি অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। সংসদ তো আইন প্রণয়নের দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর হস্তান্তর করেননি। আমাদের সংবিধানে কি থাকবে আর কি থাকবে না তা আইনপ্রণেতাদের ওপরই নির্ধারণের দায়িত্ব রয়েছে। অন্যদের নয়।
সুপ্রিম কোর্টে সাবেক রেজিস্ট্রার ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ইকতেদার আহমেদ জানান, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আইন প্রণয়নের েেত্র আইনের খসড়া প্রস্তুত করার পর জনমত যাচাইয়ের জন্য আইন কমিশনের মাধ্যমে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ আয়োজন করা হয়। আইনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণপূর্বক সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করা হয়। আমাদের দেশে ১৯৯৬ সালে আইন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হলেও এই কমিশন কার্যত অকার্যকর রয়েছে। জনমত যাচাই ছাড়া যেকোনো আইন প্রণয়ন করা হলে সে আইন কখনো জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে সম হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল জানান, সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭২ সালে সংবিধান পুনর্মুদ্রণে যে রায় দিয়েছেন এবং সেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কিত যে কথা বলা হয়েছে তা উপো করা হলে সেটি হবে আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ এটি হওয়া উচিত নয়। তারা স্বেচ্ছাচারিতা করেছে। আমি এখনো সংবিধানে পুনর্মুদ্রিত কপি হাতে পাইনি। তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপরই হস্তপে করা হলে এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য যারা সংবিধান পুনর্মুদ্রণের দায়িত্ব আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর অর্পণ করেছিলেন তারাও যে দায়ী তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন