টেলিভিশন আধুনিক সভ্যতার একটি বড় অবদান। আজকে এর ফলে বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে, যোগাযোগ বৃদ্ধি হয়েছে। মানুষের পরস্পরের জানাজানির সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। এসবই বিজ্ঞানের অবদান।
বিজ্ঞানের এ যুগে আমাদের অবশ্যই টেলিভিশনের পজেটিভ দিকটি দেখতে হবে। টেলিভিশন আবিষ্কারের পর থেকে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। ভালোমন্দ, সুবিধা-অসুবিধার দিকসহ এর সামগ্রিক প্রভাব আজ আমাদের কাছে স্পষ্ট। বর্তমানে আমরা এমন পযার্য়ে এসে পৌছেছি যে, টেলিভিশনের খারাপ দিকগুলো রিভিউ করে দেখার প্রয়োজন। আমি ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় দেখেছি অনেক বাড়িতে টিভি রাখা হয় না। এ মানসিকতা সম্পন্ন লোক সেখানে আছে। তবে অন্যান্য দেশের কথা আমি ঠিক বলতে পারব না।
বছর তিনেক আগে আমার এক ছাত্র আমাকে একটি বই উপহার দেয়। বইটির নাম ছিল (ঋড়ঁৎ অৎমঁসবহঃং ভড়ৎ ঃযব ঊষবসরহধঃরড়হ ড়ভ ঞবষবারংরড়হ) লেখক ঔবৎৎু গবহফবৎ, বইটি আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়। সেখানে টেলিভিশনের তিকর ছয়টি দিক তুলে ধরে বলা হয়েছে, এ ছয়টি কারণে টিভি বন্ধ করে দেয়া উচিত। এছাড়াও ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে টেলিভিশনের তিকর দিকগুলো আমাদের সামনে বিভিন্ন সময় তুলে ধরা হয় এসব কী প্রমাণ করে? এসব প্রমাণ করে যে টিভির ব্যবহার বা টিভির কল্যাণকামিতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। তবে সে প্রশ্ন কতটুকু সঠিক আমি সে সামগ্রিক আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু সে প্রশ্ন উঠেছে, আর তা উঠেছে পাশ্চত্য দেশগুলোতে। একরম বই আমাদের দেশেও লেখা হয়নি।
আমাদের দেশে সরকারি, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো উন্মক্ত। এসব চ্যানেলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান দিকটি হলো খবর। এরপরই দেখা যায় নাচ, গান আর সিনেমা। নাচ, গান, সিনেমাই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ৫০ থেকে ৬০ ভাগ জুড়ে রয়েছে। সেখানে খেলাধূলার প্রোগ্রাম রয়েছে। তবে খেলাধুলার জন্য কয়েকটি আলাদা চ্যানেলই আছে। ২৪ ঘন্টাই খেলাধূলা সংক্রান্ত অনুষ্ঠান সেখানে দেখানো হচ্ছে। আবার কার্টুন চ্যানেলও আছে। কিন্তু সমাজের এর প্রভাব কি পড়ছে? বাস্তবে এটিকে কীভাবে দেখা হচ্ছে এবং মানুষের সময় কীভাবে ব্যয় হচ্ছে? সার্বিকভাবে আমরা দেখতে পাই শিশু- কিশোর থেকে যুবক শ্রেণী পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে অনেকেরই ৬/৭ ঘন্টা টেলিভিশনের পিছনে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা স্পোর্টস এডিকশনের বা নেশার ফলে ৫/৬ ঘন্টা খেলা দেখার জন্য ব্যয় করছে। এটি অনেকের েেত্র প্রযোজ্য। এতে তাদের অন্যান্য কাজের ব্যাঘাত হচ্ছে। লেখাপড়ার তি হচ্ছে। তেমনি বাচ্চারা কার্টুন নিয়ে প্রায় ব্যস্ত থাকে। আবার কার্টুনের সব ভালো আমি বলবো না। সেখানেও মারামারি আছে, অস্ত্র চালানোর ব্যাপার আছে সেসব দেখে বাচ্চাদের একটু বয়স হলে তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, আমার বন্দুক কোথায়? একজন যদি তার দিনের ৪ বা ৬ ঘন্টা টেলিভিশনের পিছনে ব্যয় করে তাহলে অবস্থা কেমন দাড়াঁয়।
তুলনামূলক ভাবে ভালো প্রোগ্রাম হলেও সেখানে ৪/৫ ঘন্টা ব্যয়ের প্রশ্ন চলে আসে। আমাকে বিভিন্ন ব্যক্তি টিভি সিরিয়ালের কথা বলেছে সেগুলো কতটুকু ভালো, কতটুকু কল্যাণকর আর জ্ঞানের, আমি সে বিষয়ের দিকে যাবো না। এ সিরিয়াল, মেগাসিরিয়াল প্রোগ্রামের একটি প্রভাব হলো, এর ফলে মহিলারা এ প্রোগ্রাম দেখতে যেয়ে প্রতিবেশীর সাথে দেখা-সাাতে সময় বের করতে পারেন না। আগে মহিলারা যেভাবে এক বাড়িতে থেকে আরেক বাড়িতে যেতেন,পারস্পরিক যোগাযোগ রা করতেন পাশের বাড়ি যেতেন সেটা কমে এসছে এবং তারা সর্ম্পূণ ঘরমুখী হয়ে যাচ্ছেন। তাদের মাথায় থাকছে কোন কোন সময় কোন প্রোগ্রাম শুরু হবে আর কোনটা দেখতে হবে। এর ফলে দেখা গেছে আমাদের সামজিকতা পর্যন্ত তিগ্রস্থ হয়ে গেছে। এতে আমাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, কল্যাণকামিতা,খোজঁ খবর নেয়া ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
এ স্পোর্টসে, কার্টুন, নাচ, গান সিনেমা কিংবা সিরিয়াল মেগাসিরিয়াল প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষের যে খুব একটা মানসিক উন্নয়ন হয় কিংবা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় তা বলা যায় না। এর সার্বিক প্রভাব নৈতিকও নয়, কল্যাণকরও নয়। কিছু কিছু ভালো প্রোগ্রাম আছে। এ বিষয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু সার্বিক প্রভাব কল্যানকর তা বলা মুশকিল।
টেলিভিশন প্রসঙ্গে আমি এখানে যে বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই তা হচ্ছে সময় অপচয় প্রসঙ্গ। টেলিভিশন প্রোগ্রামে মধ্যে কতটা আদর্শ, নৈতিকতা আছে আর কতটা নেই এসব আলোচনা আমার আজকের মূল বিষয় নয়। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে যে, এতে কতটা সময় যাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যেই ল্য করেছি ছেলেমেয়ে, বাচ্চা, গৃহিনী আর ছাত্রদের কি পরিমাণ সময় টেলিভিশনের প্রোগ্রামের পিছনে যায়। আমরা এও ল্য করলাম যে এ সময়ের পরিমান দিনে ১ ঘন্টা নয়, বরং গড়ে ৪ ঘন্টা ৫ ঘন্টা যাচ্ছে। কোনো কোনো েেত্র ৭/৮ ঘন্টাও যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি জাতির জন্য ভয়াবহ তিকর। একটি স্টাডিতে দেখা গেছে যে. একজন মানুষের ৫০/৬০ বছরের জীবনে ১২ বছর সময়ই ব্যয় হয়েছে শুধু টিভির পিছনে। একটি জীবনে যদি এ ১২ বছরই টিভির পিছনে যায় তাহলে তার অবস্থা কেমন আমরা কল্পনা করতে পারি। উৎ.ঐরংযধহ অষঃধষরন তার ঞৎধরহরম এঁরফব ঋড়ৎ ওংষধসরপ ডড়ৎশবৎং বইতে এ হিসাবের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর সমাধান কি? আমার মনে হয় এর জন্য একটি আন্দোলন দরকার। এ আন্দোলন সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক সকল পর্যায় থেকে করতে হবে। সে আন্দোলনের শ্লোগান হবে - ‘আমরা টিভি দেখব কম’। এখানে আমরা টিভি দেখব না বা টিভি ব্যান্ড করে দিতে বলছি না। এখানে আমরা শুধু বলছি, টিভি দেখার সময় আমাদের কমাতে হবে। যে যার পছন্দ অনুযায়ী টিভি প্রোগ্রাম বেছে নিতে পারে। কিন্তু এ জন্য সারাদিনই তাকে টিভি দেখতে হবে তাঁর কোনো যৌক্তিকতা নেই। যে খবর দেখতে চায় দেখবে। কেউ তার নিজের সবচেয়ে বেশি পছন্দের অনুষ্ঠান বেছে নিয়ে যদি শুধু সেটিই সীমিত সময় দেখে তাহলেও তার অনেক সময় বেঁেচ যায়। দিনে ১/২ বার খবরসহ সপ্তাহে কিছু ভালো অনুষ্ঠান কিংবা শিমূলক অনুষ্ঠান, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি দেখল। তবে আমাদেরকে টিভি দেখার সময় অবশ্য অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে যদি আমরা জাতি গঠন করতে চাই। জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে সময়। সময় হচ্ছে জীবন। জীবন হচ্ছে সময়। সময়ই যদি আমরা অপচয় করে দেই তাহলে কি করে আমাদের উন্নতি সম্ভব হবে। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক কোনো উন্নয়নই সময়ের সদ্ব্যবহার ছাড়া সম্ভব নয়। “তাই আমাদের শ্লোগান হওয়া উচিত আমরা টেলিভিশন কম দেখব এবং আমরা সময়কে কাজে লাগাব।” এর ফলে যে বিশাল সময় বেঁেচ যাবে তা আমরা ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারি। যেমন আমরা আমাদের ছাত্রজীবনের সময়গুলোতে বিভিন্ন সাহিত্য পড়তাম। নবী রাসূলের জীবনী, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য পড়তাম।
আজকের দিনে সেগুলো পড়ার সংখ্যা খুবই কমে গেছে। এটি যে কত বড় তি তা আমরা একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারব। সাহিত্য না পড়ার জন্যও সময়কে অনেক েেত্র দায়ী করা হয়। সাহিত্য হচ্ছে মানুষের জীবনের দর্পণ। এটি একটি দিক। অন্যদিক হচ্ছে সাহিত্য মানুষকে মহৎ করে। যারা ওয়ার্ল্ড কাসিক পড়বে, টলষ্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, পার্লবাক আর রবীন্দ্রনাথ হোক বা আল্লামা ইকবাল হোক, নজরুলের হোক তারাই জীবনে মহৎ হবে। এদের দ্বারা মানবতা কল্যাণ পাবে। অথচ আজকে সে রকম লোক তৈরি হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো বেশির ভাগ লোক আজকে সাহিত্য পড়ছে না। যখন একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে সেখানে সে প্রফেশনাল শিাই পাচ্ছে। সেখানেও সাহিত্যের গুরুত্ব কম। বাংলা পড়লে আমরা নাক সিটকাচ্ছি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বলছে এগুলো পড়ার দরকার কি? আমাদের সে শিা দরকার যা আমাদের কনস্ট্রাকশনের কাজে লাগবে । কিন্তু প্রকৃতপে এর দ্বারা মানুষ রোবট তৈরি হবে। মানুষ তৈরি হবে না । আমরা এ জিনিসটি ভুলে যাচ্ছি।
এ পরিস্থিতিতে আমার মনে হচ্ছে আমাদের একটি আত্মনিয়ন্ত্রণ দরকার। আমাদের সময় বাঁচাতে হবে। আমরা সময়কে বাঁচাবো । সময়কে মানবতার কাজে লাগাব মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করব। জাতির কল্যাণে জাতি গঠনে ব্যবহার করব। এ সময়কে আমরা ফ্যামিলির ডেভেলপমেন্টের কাজে ব্যবহার করব। নিজের আত্মগঠনে ব্যবহার করব। আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশীর জন্য ব্যবহার করব।
নিজেরা নিজেদের সময়কে বাঁচাবো। আমরা কতণ টিভি দেখব তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু সরকার চাইলে খারাপ চ্যানেলগুলো যতদিন পর্যন্ত ততদিন সেসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ উদ্যোগ অবশ্যই সরকারকে নেয়া উচিত। সরকারকে অবশ্যই এসব খারাপ চ্যানেলগুলে ব্যাপারে হস্তপে করতে হবে।
সর্বশেষে গোটা জাতির কাছে বলতে চাই সকলেই এ বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং প্রত্যেকেই তার নিজের ফ্যামিলিতে টিভি ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করবেন।
এ ব্যাপারে ফ্যামিলির মায়েদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। তারা নিজেরাই যদি বেশি করে টিভি দেখেন তাহলে বাচ্চাদের কে আটকানো সম্ভব হবে না বলে আমি মনে করি। এ বিষয়টি সকলেই বিশেষ বিবেচনা করে দেখবেন। পত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। এটি একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। যা আমাদেরই কল্যাণ হবে। আমার মতে,“আমরা টিভি দেখব কম ঃ সময়কে কাজে লাগাব” এ স্লোগান জাতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
লেখক ঃ
সাবেক সচিব
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
ভাল লাগল । আমার রিসার্স প্রপোজল এ কাজে লাগবে । লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
উত্তরমুছুন