“হে বসন্ত, হে সুন্দর, ধরনীর ধ্যানভরা ধন, বৎসরের শেষে। শুধু একবার মর্তো মূর্তি ধরো ভুবনমোহন নব বরবেশে!” ধনধান্যে পুষ্পে ভরা এ বসুন্ধরার রূপবৈচিত্র পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। বাংলার প্রকৃতির রূপ, রস গন্ধ অবিরত রং বদলায় । ঋতুবৈচিত্র্যে বাংলার প্রকৃতি সাজে নানান সাজে। অফুরন্ত এরূপ সর্বদা নব নব সাজে সজ্জিত হয়। সুজলা -সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ বৈচিত্রময় দেশ কখনো ভৈরবী রূপ নেয়, কখনো বিুদ্ধ হয়ে ওঠে, কখনো সজল কালো চোখ তুলে ভালোবাসার বান ছুঁড়ে দেয় প্রকৃতির সন্তানদের দিকে। কখনো কিশোরী মেয়েদের মতো বাঁকা চায় , কখনো যৌবন রসে সিক্ত করে সবাইকে। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার অফুরন্ত রূপ কখনো ফুরিয়ে যায় না। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে অন্যতম বৈচিত্রময় দেশ। অফুরন্ত এ রূপ নব নব সাজে সজ্জিত হয়। ছয়টি ঋতু পর্যায়ক্রমে আসে। শীতের বুড়ির কুয়াশার ঘোমটা খুলে প্রকৃতিতে হাজারো ফুলে রং ধরিয়ে দিতে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। ঋতুরাজের আগমনে মৃদুমন্দ দনিা বাতাসের যাদুস্পর্শে বর্ণবিরল পৃথিবীর সর্বাঙ্গে লাগে অপূর্ব পুলক প্রবাহ, বনবীথিরন রিক্ত শাখায় জাগে কচি কিশলয়ের অফুরন্ত উল্লাস। বাতাসের মৃদু মর্মর ধ্বনি এবং দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুগীতি পৃথিবীকে সৃষ্টি করে এক অপরূপ মায়া নিকেতন। অশোক পলাশের রঙিন বিহবলতায় ও শিমুল কৃষ্ণচূড়ায় বিপুল উল্লাসে, মধুমালতী ও মাধবী মঞ্জুরীর উচ্ছল গন্ধমদির প্রবল তায় সারা আকাশ তলে গন্ধ, বর্ণ ও গানের তুমুল কোলাহলে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি। কবির ভাষায়-
কুহেলি ভেদিয়া
জড়তা টুটিয়া
এসেছে বসন্তরাজ।
নবীন আলোকে
নবীন পুলকে
সাজিয়েছে ধরণী আজ।”
শীতে প্রকৃতি রিক্ত হয়। শীত যেন বসন্তের পটভূমি তৈরি করে। নবপত্র সম্ভারে, বর্ণগন্ধময় পুষ্পের সমারোহ, পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আসে ঋতুরাজ বসন্ত। শীত ও গ্রীষ্মের এই সন্ধিকালটি পরম রমনীয়। ফাল্গুনের আগমনে নবপল্লবে সুশোভিত হয় গাছপালা, বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের পুষ্পে সুশোভিত হয়ে ওঠে পৃথিবী। গন্ধ ও বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় কোকিলের কুহুধ্বনি এবং অন্যান্য গায়কী পাখির কন্ঠ। এ যে প্রকৃতির নব যৌবনের প্রতিমূর্তি। ঋতুরাজের যাদুময়ী স্পর্শে গাছপালা তৃনলতায় নতুন নতুন পাতায় সুশোভিত হয়ে ওঠে । আকাশে বাতাসে গোলাপ কিংশুকে আনন্দের শিহরন বয়ে যায়। পৃথিবীতে যেন স্বর্গের সৌন্দর্য নেমে আসে। মানুষের মনে আনন্দ ধরে না। শীতকালে কনকনে শীত সহ্য করতে না পেরে যে মধুকন্ঠ কোকিল লুকিয়ে থাকে তারা আবার ফিরে আসে বসন্তের সময় । পাতার আড়াল থেকে শোনা যায় তাদের সুমধুর গান। বসন্তকালে আম, জাম, লিচু প্রভৃতি গাছে মুকুল ধরে। মুকুলের গন্ধে মৌমাছি ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। এদের গুঞ্জনে চারদিক মুখোরিত হয়ে ওঠে। প্রজাপতি তার রঙিন ডানা মেলে উড়তে থাকে। তখন মৃদুমন্দ দনিা বাতাস বয়ে যায়। সকলের অঙ্গে বুলিয়ে দেয় শান্তির পরশ। প্রকৃতির সারা অঙ্গে যৌবনের ঢেউ খেলে যায় এবং মাটির পৃথিবী নতুন আনন্দে হাসতে থাকে। দিনে সূর্যের আলো এবং রাতে চাঁদের স্নিন্ধ কিরণ পৃথিবীর বুক থেকে শীতের কালিমা দূর করে দেয়। তখন বনে বনে ফোটে শিমুল ,কৃষ্ণচূড়া, অশোক, পলাশ, প্রভৃতি ফুল। তাদের উজ্জল লাল রং সকলের হৃদয় রাজ্যে রঙের পরশ বুলিয়ে দেয়। তাইতো কবি মাইকেল মধুসূধন দত্তের কন্ঠে বসন্তের সৌন্দর্য বর্ণনা শুনি এভাবে
ফুটিল বকুল ফুল কেন লো গোকুলে আজি
কহ না সজলি?
আইল কি ঋতুরাজ? ধরিলা কি ফুলসাজ
বিলাসে ধরণী?
শহুরে জীবনটা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি না থাকায় প্রকৃতির রং ধরার গল্পটা হয়তো শহুরেদের মনে দোলা দেয় না। কিন্তু ই্ট -কাঠ-পাথরের এ-নগর জীবনের একটি ঋতুর জন্য আমরা রাঙিয়ে নেই নিজেকে ফাল্গুনের রংয়ে। বসন্তকে বরণ করে নিতে এই যে উৎসব পহেলা ফাল্গুন আমাদের উৎসাহিত করে। কারণ এর মধ্যে দিয়েই আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে দিয়ে যাই তার শেকড়ের সন্ধান। ফাল্গুনেই ধরা পড়ে এই বাংলার বিস্ময়কর সব সৌন্দর্য। কবির ভাষায়,
“ও আমার বাংলা মা তোর
আকুল করা রূপের শোভায়
হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে।
ফাগুনে তোর কৃষ্ণচূড়ায় পলাশ
বনে কিসের হাসি, চৈতি রাতে
উদাস সুরে রাখাল বাজায় বাঁশের বাঁশি।”
সত্যি বসন্ত অন্য সব ঋতুকে যেন হার মানায়। সেই সঙ্গে সোনাভরা রোদের ঝিলিক যদি আছড়ে পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই। এ ঋতুর রূপময় বৈচিত্র মনের আকাশও যেন রঙিন হয়ে ওঠে। বসন্ত ঋতুকে আরও বর্ণিল করে তোলে বাঙালির বিভিন্ন উৎসব পালন। চারদিক যেন উৎসবে মুখরিত হয়ে থাকে, আর এ উৎসবে প্রাণের আবেগে ছুটে চলে সবাই। পহেলা ফাল্গুন নিয়ে বাঙালির উৎসাহ উদ্দীপনার কোন কমতি নেই। বারো মাসে তেরো পার্বন-কথাটির যথার্থতা রাখতেই বুঝি পহেলা ফাল্গুন উৎসবের আবির্ভাব। কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এই ছোট খাটো উপলদ্ধিগুলোই এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাওয়া যায় নির্মল আনন্দ। আর এ আনন্দ যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে জীবনের সৌন্দর্য সবার চোখে ধরা দেবে। ঋতুরাজ বসন্তের অনুভূতি সম্পর্কে কবি আসাদ চৌধূরী বলেন- “বসন্ত আমার প্রিয় ঋতু। বসন্তের প্রথম দিনে তরুন-তরুনীরা সহ সব বয়সের মানুষ সুন্দর করে সাজে, যা দেখতে ভালো লাগে। বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ি, গায়ে থাকে পাঞ্জাবি ও চাদর।” বসন্তের শীত ও গ্রীষ্মের বিপরীতমুখী আচরণ এক জায়গায় এসে থমকে দাড়াঁয়। তখন থাকে না শীতের হাড়ভাঙা কাঁপুনি আর গ্রীষ্মের মাথা ফাটা উত্তাপ । তাই তখন মনে আসে নতুন উদ্যম আর দেহে আসে নতুন শক্তি এবং সামর্থ। সকলেই শীতের জড়তা কাটিয়ে সতেজ প্রাণ, নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজে লেগে যায়। বসন্তের সৌন্দর্যে সারা দেশকে আন্দোলিত করছে । গ্রামের এই সীমাহীন মাঠ, পথ , ঘাট সর্বত্রই হাওয়ায় কম্পমান । বসন্তে ফিরে আসে প্রতিটি প্রানীর মনে সতেজ অনুভূতি, সতেজ জীবন। শুধু গ্রামে নয় , বি বিধন আর ফ্যাট, কালচারে নি®প্রান প্রায় এই কংক্রিটের জঙ্গল রাজধানীতেও এখন যেটুকু সামান্য সবুজ আছে সেখানে গেলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। বোটানিক্যাল গার্ডেন , রমনা পার্ক, বনানী লেক, ধানমণ্ডি লেক, সোহরাওযাদীউদ্যান, মিন্টু রোড, বলধা গার্ডেন, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গন ফুলে ফুলে উচ্ছল -উজ্জল এখন বাসন্তী হাওয়ায়। এসব এলাকায় কোকিলের কুহুস্বরে মুখর পরিবেশ মন যেন কোন উ দাস লোকে হারিয়ে যেতে চায়। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে বসন্ত জানিয়ে দিয়ে যায় সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা। বসন্তের বানী নতুন কে বরণ করার পুরাতনকে বর্জন করার, ফাল্গুন ও চৈত্র এ দুটি মাস অতি মধুর রূপে সেই বানীকে বসন্তের বীনায় ঝংকৃত করে তোলে।
বসন্তকালে গাছে গাছে নানা রঙের ফুল ফোটে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় প্রকৃতি । সৌরভে আসে অলি, ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখরিত কৃঞ্জবন। প্রকৃতির রূপের নেশায় মানুষ মাতাল হয়ে ওঠে। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়ে থাকে। কবির ভাষায়
“আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।”
ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে বাংলার সবুজ প্রকৃতির অঙ্গন। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে
“ফাগুনে হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
আমার আপন হারায় প্রান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার অশোকে কিংশুকে
অল্েয রঙ লাগল আমার অকারনের সুখে।”
সত্যি সত্যি অকারনে সুখের হাওয়ায় দুলিয়ে দেয় বাঙালির হৃদয় । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের বাউল কবির হৃদয় পর্যন্ত বার বার দুলিতেছে ঋতুরাজ বসন্তে। সে জন্যই বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের সুবাসে মন আনচান করে বাউল কবিরও। সেই মন কেমন করা অনুভবে বাংলার ঋতুরাজের আগমনী দিনে আজ আনন্দের হাট বসেছে রাজধানীসহ সারাদেশের সচেতন অগ্রসর তরুন -তরুনীদের মনে। তাদের যেন কোথাও আর হারিয়ে যেতে নেই মানা। তরুন-তরুনীদের মনে মনে গুঞ্জরিত হবে ভালোলাগার গান, ভালোবাসার গান। তাঁদের হৃদয়ে যেন বাজিতেছে সুরের ধ্বনি।
এই মধুর বসন্ত ঋতুতে ও মানুষ নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কলেরা বসন্ত, টাইফয়েড, প্রভৃতি মারাতœক ব্যাধি আনন্দের মাঝে নিরানন্দের ছায়া পাত করে। তবুও বসন্তের যে বাড়তি সৌন্দর্য ভূলে যাওয়া চলবে না। এখন দনিা মলয় এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় শাড়ির আঁচল তখনি মনে পড়ে সেই শৈশবের কিছু কিছু গান। যা কখনো ভুলবার নয়। তাই যেন মনে পড়ে যায়
“দনিা মলয় ঢেউখেলে যায়-
মনের বাতায়নে’/ শৈশবের কত স্মৃতি
পড়ে যায় মনে।”
শুধু তাই নয়। শীত ও গ্রীষ্মের মাঝখানে অবস্থিত বসন্তকাল মানুষের পে খুবই আরামপ্রদ। প্রানের আরামের সঙ্গে দেহের আরামের অবকাশও এই ঋতুতে তৈরী হয়। নানাবিধ রবি শস্য এবং নানাবিধ রসালো ফলের উপহার দেয় বসন্ত। আর থাকে মলয় বায়ু ফুলের সৌরভ ও কোকিলের কুহুতানে মন জুড়ানো আনন্দ। যখন শাখে শাখে পুষ্প ফোটে, দনিা মলয় ঢেউ খায় পাতায় পাতায়। কোকিলের কুহুকুহু তানে মুখরিত হয়ে উঠে কানন, তখনই সেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে যায়। যখনই মহাসমারোহে বসন্ত তার অপরূপ পরসার ডালি সাজিয়ে প্রকৃতির দ্বারে উপস্থিত হয়, প্রকৃতির পরতে পরতে সৌন্দর্য ঢেউ প্রবাহিত হয়, বাতাবি লেবুর গন্ধে চারদিক সুশোভিত । আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত তখনই সেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে যায়।
কবি সুফিয়া কামালের ভাষায় -
“কুহেলি উত্তরী তালে মাঘের সন্নাসী
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূণ্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে , ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
আবার না পাওয়ার বেদনাও কিন্তু কম নয়। যাইহোক, বসন্ত আসার সাথে সাথে স্রোতস্বিনীর মর্হোমি ছন্দের তালে তালে রুনু ঝুনু রুনু ঝুনু করে বাজতে থাকে। মন চায় নদীর পাড়ে গিয়ে আনমনা হয়ে বসে, বিশুদ্ধ দনিা মলয় গ্রহন করতে। মন চায় সতেজ অনুভূতির নি:শ্বাস ত্যাগ করতে। নদীর সাথে সারাটি ণ বসে মিতালী গড়ে তুলতে ইচ্ছে করে। মনের যত অজানা কথা আছে তা নীরবে নদীর সাথে বলতে ইচ্ছে করে। কবির ভাষায়-
“সারাটি ণ নদীর সনে
বলব কথা যত মনে
কূল কূল নদীর বানে
প্রাণ জুড়াব ঢেউয়ের তানে।”
শীতের ত্যাগের সাধনা বসন্তে সার্থক হয়ে ওঠে । প্রকৃতির সারা অঙ্গে নতুন প্রাণ। নতুন উৎসাহ বসন্ত হয়েছে ঋতুরাজ। বসন্ত মানুষের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি। বসন্ত যে সুন্দর , আর সুন্দর মুখের জয়ই তো সর্বত্র বসন্ত যৌবনের ঋতু, সুন্দরের ঋতু আনন্দের ঋতু। তাই সে ঋতুরাজ। তাই তো
ফুলে ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জনে,
কুহু কুহু কোকিলেরন তানে
মুখরিত ধরনী মন নাহি মানে।
মুষমামন্ডিত স্বর্গের কাল্পনিক সুখের চেয়ে
আনন্দ সুখ বিরাজমান
অনুভূত এখানে।
যুগ যুগ ধরে সুন্দরের পূজারিরা সৌন্দর্যের পূজা করে গেছেন। তাই বাঙালি এবং বাঙালিদের আচার আকৃতি -প্রকৃতি প্রভৃতি বলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেত হয়। বসন্তের সৌন্দর্যের মতে প্রতিটি মানুষের জীবন আনন্দ উল্লাসে ভরে উঠুক সেই আশাই কামনা করি।
লেখক : শিার্থী
গলাচিপা ডিগ্রি কলেজ
গলাচিপা , পটুয়াখালী।
কুহেলি ভেদিয়া
জড়তা টুটিয়া
এসেছে বসন্তরাজ।
নবীন আলোকে
নবীন পুলকে
সাজিয়েছে ধরণী আজ।”
শীতে প্রকৃতি রিক্ত হয়। শীত যেন বসন্তের পটভূমি তৈরি করে। নবপত্র সম্ভারে, বর্ণগন্ধময় পুষ্পের সমারোহ, পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আসে ঋতুরাজ বসন্ত। শীত ও গ্রীষ্মের এই সন্ধিকালটি পরম রমনীয়। ফাল্গুনের আগমনে নবপল্লবে সুশোভিত হয় গাছপালা, বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের পুষ্পে সুশোভিত হয়ে ওঠে পৃথিবী। গন্ধ ও বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় কোকিলের কুহুধ্বনি এবং অন্যান্য গায়কী পাখির কন্ঠ। এ যে প্রকৃতির নব যৌবনের প্রতিমূর্তি। ঋতুরাজের যাদুময়ী স্পর্শে গাছপালা তৃনলতায় নতুন নতুন পাতায় সুশোভিত হয়ে ওঠে । আকাশে বাতাসে গোলাপ কিংশুকে আনন্দের শিহরন বয়ে যায়। পৃথিবীতে যেন স্বর্গের সৌন্দর্য নেমে আসে। মানুষের মনে আনন্দ ধরে না। শীতকালে কনকনে শীত সহ্য করতে না পেরে যে মধুকন্ঠ কোকিল লুকিয়ে থাকে তারা আবার ফিরে আসে বসন্তের সময় । পাতার আড়াল থেকে শোনা যায় তাদের সুমধুর গান। বসন্তকালে আম, জাম, লিচু প্রভৃতি গাছে মুকুল ধরে। মুকুলের গন্ধে মৌমাছি ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। এদের গুঞ্জনে চারদিক মুখোরিত হয়ে ওঠে। প্রজাপতি তার রঙিন ডানা মেলে উড়তে থাকে। তখন মৃদুমন্দ দনিা বাতাস বয়ে যায়। সকলের অঙ্গে বুলিয়ে দেয় শান্তির পরশ। প্রকৃতির সারা অঙ্গে যৌবনের ঢেউ খেলে যায় এবং মাটির পৃথিবী নতুন আনন্দে হাসতে থাকে। দিনে সূর্যের আলো এবং রাতে চাঁদের স্নিন্ধ কিরণ পৃথিবীর বুক থেকে শীতের কালিমা দূর করে দেয়। তখন বনে বনে ফোটে শিমুল ,কৃষ্ণচূড়া, অশোক, পলাশ, প্রভৃতি ফুল। তাদের উজ্জল লাল রং সকলের হৃদয় রাজ্যে রঙের পরশ বুলিয়ে দেয়। তাইতো কবি মাইকেল মধুসূধন দত্তের কন্ঠে বসন্তের সৌন্দর্য বর্ণনা শুনি এভাবে
ফুটিল বকুল ফুল কেন লো গোকুলে আজি
কহ না সজলি?
আইল কি ঋতুরাজ? ধরিলা কি ফুলসাজ
বিলাসে ধরণী?
শহুরে জীবনটা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি না থাকায় প্রকৃতির রং ধরার গল্পটা হয়তো শহুরেদের মনে দোলা দেয় না। কিন্তু ই্ট -কাঠ-পাথরের এ-নগর জীবনের একটি ঋতুর জন্য আমরা রাঙিয়ে নেই নিজেকে ফাল্গুনের রংয়ে। বসন্তকে বরণ করে নিতে এই যে উৎসব পহেলা ফাল্গুন আমাদের উৎসাহিত করে। কারণ এর মধ্যে দিয়েই আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে দিয়ে যাই তার শেকড়ের সন্ধান। ফাল্গুনেই ধরা পড়ে এই বাংলার বিস্ময়কর সব সৌন্দর্য। কবির ভাষায়,
“ও আমার বাংলা মা তোর
আকুল করা রূপের শোভায়
হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে।
ফাগুনে তোর কৃষ্ণচূড়ায় পলাশ
বনে কিসের হাসি, চৈতি রাতে
উদাস সুরে রাখাল বাজায় বাঁশের বাঁশি।”
সত্যি বসন্ত অন্য সব ঋতুকে যেন হার মানায়। সেই সঙ্গে সোনাভরা রোদের ঝিলিক যদি আছড়ে পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই। এ ঋতুর রূপময় বৈচিত্র মনের আকাশও যেন রঙিন হয়ে ওঠে। বসন্ত ঋতুকে আরও বর্ণিল করে তোলে বাঙালির বিভিন্ন উৎসব পালন। চারদিক যেন উৎসবে মুখরিত হয়ে থাকে, আর এ উৎসবে প্রাণের আবেগে ছুটে চলে সবাই। পহেলা ফাল্গুন নিয়ে বাঙালির উৎসাহ উদ্দীপনার কোন কমতি নেই। বারো মাসে তেরো পার্বন-কথাটির যথার্থতা রাখতেই বুঝি পহেলা ফাল্গুন উৎসবের আবির্ভাব। কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এই ছোট খাটো উপলদ্ধিগুলোই এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাওয়া যায় নির্মল আনন্দ। আর এ আনন্দ যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে জীবনের সৌন্দর্য সবার চোখে ধরা দেবে। ঋতুরাজ বসন্তের অনুভূতি সম্পর্কে কবি আসাদ চৌধূরী বলেন- “বসন্ত আমার প্রিয় ঋতু। বসন্তের প্রথম দিনে তরুন-তরুনীরা সহ সব বয়সের মানুষ সুন্দর করে সাজে, যা দেখতে ভালো লাগে। বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ি, গায়ে থাকে পাঞ্জাবি ও চাদর।” বসন্তের শীত ও গ্রীষ্মের বিপরীতমুখী আচরণ এক জায়গায় এসে থমকে দাড়াঁয়। তখন থাকে না শীতের হাড়ভাঙা কাঁপুনি আর গ্রীষ্মের মাথা ফাটা উত্তাপ । তাই তখন মনে আসে নতুন উদ্যম আর দেহে আসে নতুন শক্তি এবং সামর্থ। সকলেই শীতের জড়তা কাটিয়ে সতেজ প্রাণ, নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজে লেগে যায়। বসন্তের সৌন্দর্যে সারা দেশকে আন্দোলিত করছে । গ্রামের এই সীমাহীন মাঠ, পথ , ঘাট সর্বত্রই হাওয়ায় কম্পমান । বসন্তে ফিরে আসে প্রতিটি প্রানীর মনে সতেজ অনুভূতি, সতেজ জীবন। শুধু গ্রামে নয় , বি বিধন আর ফ্যাট, কালচারে নি®প্রান প্রায় এই কংক্রিটের জঙ্গল রাজধানীতেও এখন যেটুকু সামান্য সবুজ আছে সেখানে গেলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। বোটানিক্যাল গার্ডেন , রমনা পার্ক, বনানী লেক, ধানমণ্ডি লেক, সোহরাওযাদীউদ্যান, মিন্টু রোড, বলধা গার্ডেন, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গন ফুলে ফুলে উচ্ছল -উজ্জল এখন বাসন্তী হাওয়ায়। এসব এলাকায় কোকিলের কুহুস্বরে মুখর পরিবেশ মন যেন কোন উ দাস লোকে হারিয়ে যেতে চায়। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে বসন্ত জানিয়ে দিয়ে যায় সত্যি সত্যি সে ঋতুর রাজা। বসন্তের বানী নতুন কে বরণ করার পুরাতনকে বর্জন করার, ফাল্গুন ও চৈত্র এ দুটি মাস অতি মধুর রূপে সেই বানীকে বসন্তের বীনায় ঝংকৃত করে তোলে।
বসন্তকালে গাছে গাছে নানা রঙের ফুল ফোটে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় প্রকৃতি । সৌরভে আসে অলি, ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখরিত কৃঞ্জবন। প্রকৃতির রূপের নেশায় মানুষ মাতাল হয়ে ওঠে। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়ে থাকে। কবির ভাষায়
“আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।”
ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে বাংলার সবুজ প্রকৃতির অঙ্গন। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে
“ফাগুনে হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
আমার আপন হারায় প্রান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার অশোকে কিংশুকে
অল্েয রঙ লাগল আমার অকারনের সুখে।”
সত্যি সত্যি অকারনে সুখের হাওয়ায় দুলিয়ে দেয় বাঙালির হৃদয় । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের বাউল কবির হৃদয় পর্যন্ত বার বার দুলিতেছে ঋতুরাজ বসন্তে। সে জন্যই বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের সুবাসে মন আনচান করে বাউল কবিরও। সেই মন কেমন করা অনুভবে বাংলার ঋতুরাজের আগমনী দিনে আজ আনন্দের হাট বসেছে রাজধানীসহ সারাদেশের সচেতন অগ্রসর তরুন -তরুনীদের মনে। তাদের যেন কোথাও আর হারিয়ে যেতে নেই মানা। তরুন-তরুনীদের মনে মনে গুঞ্জরিত হবে ভালোলাগার গান, ভালোবাসার গান। তাঁদের হৃদয়ে যেন বাজিতেছে সুরের ধ্বনি।
এই মধুর বসন্ত ঋতুতে ও মানুষ নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কলেরা বসন্ত, টাইফয়েড, প্রভৃতি মারাতœক ব্যাধি আনন্দের মাঝে নিরানন্দের ছায়া পাত করে। তবুও বসন্তের যে বাড়তি সৌন্দর্য ভূলে যাওয়া চলবে না। এখন দনিা মলয় এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় শাড়ির আঁচল তখনি মনে পড়ে সেই শৈশবের কিছু কিছু গান। যা কখনো ভুলবার নয়। তাই যেন মনে পড়ে যায়
“দনিা মলয় ঢেউখেলে যায়-
মনের বাতায়নে’/ শৈশবের কত স্মৃতি
পড়ে যায় মনে।”
শুধু তাই নয়। শীত ও গ্রীষ্মের মাঝখানে অবস্থিত বসন্তকাল মানুষের পে খুবই আরামপ্রদ। প্রানের আরামের সঙ্গে দেহের আরামের অবকাশও এই ঋতুতে তৈরী হয়। নানাবিধ রবি শস্য এবং নানাবিধ রসালো ফলের উপহার দেয় বসন্ত। আর থাকে মলয় বায়ু ফুলের সৌরভ ও কোকিলের কুহুতানে মন জুড়ানো আনন্দ। যখন শাখে শাখে পুষ্প ফোটে, দনিা মলয় ঢেউ খায় পাতায় পাতায়। কোকিলের কুহুকুহু তানে মুখরিত হয়ে উঠে কানন, তখনই সেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে যায়। যখনই মহাসমারোহে বসন্ত তার অপরূপ পরসার ডালি সাজিয়ে প্রকৃতির দ্বারে উপস্থিত হয়, প্রকৃতির পরতে পরতে সৌন্দর্য ঢেউ প্রবাহিত হয়, বাতাবি লেবুর গন্ধে চারদিক সুশোভিত । আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে সুবাসিত তখনই সেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে যায়।
কবি সুফিয়া কামালের ভাষায় -
“কুহেলি উত্তরী তালে মাঘের সন্নাসী
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূণ্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে , ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
আবার না পাওয়ার বেদনাও কিন্তু কম নয়। যাইহোক, বসন্ত আসার সাথে সাথে স্রোতস্বিনীর মর্হোমি ছন্দের তালে তালে রুনু ঝুনু রুনু ঝুনু করে বাজতে থাকে। মন চায় নদীর পাড়ে গিয়ে আনমনা হয়ে বসে, বিশুদ্ধ দনিা মলয় গ্রহন করতে। মন চায় সতেজ অনুভূতির নি:শ্বাস ত্যাগ করতে। নদীর সাথে সারাটি ণ বসে মিতালী গড়ে তুলতে ইচ্ছে করে। মনের যত অজানা কথা আছে তা নীরবে নদীর সাথে বলতে ইচ্ছে করে। কবির ভাষায়-
“সারাটি ণ নদীর সনে
বলব কথা যত মনে
কূল কূল নদীর বানে
প্রাণ জুড়াব ঢেউয়ের তানে।”
শীতের ত্যাগের সাধনা বসন্তে সার্থক হয়ে ওঠে । প্রকৃতির সারা অঙ্গে নতুন প্রাণ। নতুন উৎসাহ বসন্ত হয়েছে ঋতুরাজ। বসন্ত মানুষের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি। বসন্ত যে সুন্দর , আর সুন্দর মুখের জয়ই তো সর্বত্র বসন্ত যৌবনের ঋতু, সুন্দরের ঋতু আনন্দের ঋতু। তাই সে ঋতুরাজ। তাই তো
ফুলে ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জনে,
কুহু কুহু কোকিলেরন তানে
মুখরিত ধরনী মন নাহি মানে।
মুষমামন্ডিত স্বর্গের কাল্পনিক সুখের চেয়ে
আনন্দ সুখ বিরাজমান
অনুভূত এখানে।
যুগ যুগ ধরে সুন্দরের পূজারিরা সৌন্দর্যের পূজা করে গেছেন। তাই বাঙালি এবং বাঙালিদের আচার আকৃতি -প্রকৃতি প্রভৃতি বলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেত হয়। বসন্তের সৌন্দর্যের মতে প্রতিটি মানুষের জীবন আনন্দ উল্লাসে ভরে উঠুক সেই আশাই কামনা করি।
লেখক : শিার্থী
গলাচিপা ডিগ্রি কলেজ
গলাচিপা , পটুয়াখালী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন