আপনি কেমন আছেন ?
- ভাল আছি।
- আপনি কেমন ?
- ভাল।
আমাদের সমাজ জীবনে যে কোন পরিচিতি দু’জনের মধ্যে দেখা সাাৎ ঘটলে সালাম/ আদাবের পর কুশলাদি জিজ্ঞাসা এভাবেই শুরু হয়। দু’জনই ‘ভাল’ আছেন ‘মন্দ’ কেউ নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, সবাই যদি ভালই থাকেন তাহলে মন্দের ছড়াছড়ি কেন? যাদের দেহে ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের জের, পেটে গন্ডগোল,অপুষ্টিতে চর্মসার, সারা দেহে চুলকানি, দশ আঙ্গুলের দশখানা নখের লাংগল মজলিসে বসে যেমন চলে, তেমনি চলে শয়নে স্বপনে। এমন অসুখী ব্যস্ত একজন লোককে তামাশা করে জিজ্ঞাসা করেই দেখুন না, তিনি কেমন আছেন? মনের অজান্তে স্বাভাবিক কন্ঠেই তিনি বলে ফেলবেন, ‘ভাল আছি’। এক ভিুককে অন্য চেনা এক ভিুক যখন জিজ্ঞাসা করে ‘কেমন আছ মিয়া’ ফুড়–ৎ করে জবাব আসে,‘ আল্লাহ ভালই রাখছে’। অভাবের তাড়নায় আর মনের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেজন পাগলের মত শান্তি তালাশ করে দিক থেকে দিগন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তিনিও প্রশ্নের একই উত্তর দেন ‘ভাল আছি’। যিনি ঋণে হাবুডুবু খাচ্ছেন,টেনশনে টেনশনে নিঃশেষ হচ্ছেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলে ঐ একই জাবাব পাওযা যাবে ‘ ভাল আছি’। স্বামী হারা বিধবা স্ত্রী, তার অভুক্ত কংকাল সার সন্তানকে বুকে ধরে অন্য বিধবার কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে বলেন ‘ভাল আছি’। ুধার জ্বালায় যেসব নিরন্নের বুক ফাটা হাহাকার সদা উদগত হচ্ছে, তাদের কন্ঠেও ‘ভাল থাকার’ কথা শুনা যায়। অরণীয় কন্যার বাবা বহু চেষ্টা তদবীর করে কন্যা সম্প্রদানের একটা সুযোগ পেয়েছেন; কিন্তু তাও মোটা অঙ্কের যৌতুকের বিনিময়ে। বিয়ের আর বেশি দিন বাকী নেই, এখনও অর্থের টাকা সব যোগাড় হয়নি। কন্যার বাবা পাগলের মত টাকা সংগ্রহের জন্য চেনা-অচেনা সব জায়গায় ধর্না দিচ্ছেন। দারুণ দুঃশ্চিন্তা। পথে হল পড়শীর সাথে দেখা। পড়শী শুধালেন,কেমন আছ জয়তুনের বাপ? কন্যার বাবা বুক ভরা ব্যথা আর সীমাহীন দুঃশ্চিন্তা নিয়েও কেমন করে যেন জবাব দিয়ে দিলেন ‘ভাল আছি’ ভাই। ও পাড়ার জমির আলী সাহেব দু‘দিন আগে তার কিশোর ছেলেকে কবরে শুইয়ে রেখেছেন। তাকেও দেখলাম একজনের জিজ্ঞাসার জবাবে ‘ভাল থাকার’ কথাই বললেন। অবশ্য পরবর্তী বাক্যে ছেলের তিরোধানের কথাও বলে সজল চোখে পাড়লেন। কারখানার শ্রমিক,মাঠের চাষী, নৌকার মাঝি, কামার, কুমার, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, জজ-ব্যরিস্টার, ছাত্র-শিক, অর্থাৎ সকলের কন্ঠে ভাল থাকার কথা শুনা যায়। মন্দ থাকার কথা প্রথমে বলা যেন রীতি বিরুদ্ধ। সকলেই ভাল আছেন যিনি সর্বদা মন্দ থাকেন তিনিও প্রথম মোলাকাতের সময় প্রথম সম্ভাষণে ‘ভাল থাকেন’। তারপর আস্তে আস্তে শুরু হয় মন্দ থাকার বারমাসী কিসসা কাহিনী। সকল ভাল থাকা লোক উদ্বোধনী বাক্য পর্যন্ত ভাল থাকেন। তারপর ভাল থাকার মুখোশ খসে পড়ে, সকলগোমড় ফাঁস হয়ে যায়।
এত জীবন জ্বালার মধ্যে ভাল থাকার কথা কেন অবলীলাক্রমে বের হয়ে পড়ে সে কথা ভাবতে ভাবতে একদিন রাস্তা ধরে চলছি। সামনে পড়ে গেলেন এক বন্ধু। একই প্রশ্ন
‘তুমি কেমন আছ’? ‘ভালই আছি’ এই দুটি শব্দ বের হয় হয় অবস্থা -কিন্তু ব্রেক করলাম জবাবই দিলাম না, অন্য কিছু একটা বলে কেটে পড়লাম। প্রকৃত পে আমি কি জবাব দিতে পারি বলুন? যদি বলি ভাল আছি, তাহলে মিথ্যা জবাব হয়। কারণ আমি ভাল নেই? বাত রোগ আর হার্টের রোগে ভূগছি। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। এছাড়াও আছে নানা ঝামেলা, নান ভাবনা, কোনটা দেশী আর কোনটা বিদেশী।
এত সবের পর ভাল থাকি কিভাবে? ‘ভাল আছি’ বললেই তো হলো না, ভালো থাকার পরই ‘ভাল আছি’ ঘোষণা করা চলে। সুতরাং ভাল না থেকে ভাল আছি বলা অনুচিত। মিথ্যা কথা মুখে আসেনি। তাই মিথ্যাবাদী হতে চাইনি। কিন্তু সত্য কথাও বললাম না। ‘আমি ভাল নেই’ এই স্পষ্ট কথা এ জন্যে বলেনি যে, আল্লাহ তাতে নারাজ হবেন। অকৃতজ্ঞ হবার ভয়ে সত্য কথাটাও বলিনি। কারণ রোজ কিয়ামতে আল্লাহ যখন বলবেন, তুমি ভাল না মন্দ ছিলে সে ব্যারোমিটারটা তো আমার কাছে, তুমি মন মতলবী স্বার্থপরের মত খেয়ালীকরতে গেলে কেন? ল ল লোকের চেয়ে যে তুমি ভাল আছ তা কি দেখতে পাওনি?
কি যে মুসিবত! সত্য বলাও বিপদ আবার মিথ্যা বলার শাস্তি গুরুতর। সঠিক জবাব দেয়া কঠিন। আমি ভাল আছি না মন্দ আছি তা আমি জানি না । আমার ভাল মন্দ বলার মালিক যেহেতু আমি নই, তাই ভাল মন্দের মাঝামাঝি একটা জবাব দেই। একবার এই মাঝামাঝি জবাব দিতে গিয়ে এক নাছোড়বান্দা বন্ধুর পাল্লায় পড়েছিলাম। কিভাবে বিপদে পড়েছিলাম তা বলছি।
বন্ধু ঃ কেমন আছ?
আমি ঃ বেঁেচ আছি।
- বেঁেচ যে আছ তা তো দেখতেই পাচ্ছি, তোমার বাঁচা-মরার কথা আমি জিজ্ঞাসা করিনি। আমি জানতে চাচ্ছি তুমি কিভাবে আছ?
- কোন একভাবে বেঁচে আছি।
- কোন ভাবে আর বেঁচে আছ। সেই ভাবটা কি?
- দিন কেটে যাচ্ছে একভাবে।
- যেভাবে যাচ্ছে সে ভাবের ধরণ কি?
- ধরণের ধারণা আমার নেই।
ভাল-মন্দ বুঝার যখন মতা আছে তখন ‘ধরণের ধারণা’ কেন থাকবে না?
আমার বন্ধুটি এই ভাবে আমাকে নাচিয়ে ছাড়লো। বাধ্য হয়ে অবশেষে আমাকে বলতেই হলো যে, মহা সুখে মহা আনন্দে, মরণের অপোয় আছি। আমার এই কষা উত্তর শুনে বন্ধুটি আবার জের টানলো। এবার আমি মাফ চেয়ে তার মুখ বন্ধ করলাম।
অন্য এক বন্ধুকে একবার সাধারণ রেওয়াজী জবাব দিয়েও রেহাই পাইনি। ‘ভাল আছি’ জবাব শুনে অবাক হয়ে বলল, তাহলে তুমি সত্যিই ভাল আছ? তুমি যে কত বড় ভাগ্যবান! কেউ যখন এই সংসারে ভাল নেই তখন একা একা তুমি কিভাবে ভাল থাকতে পার- আমাকে একটুখানি খুলে বলনা ভাই। তাকে আমি এই কথা বারবারই বুঝাতে লাগলাম যে, প্রথম কথাতেই তো ‘মন্দ থাকার’ দলিল-দস্তাবেজ পেশ করা যায় না। প্রথম সাাতে আলাপনে বেদনার ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়, তাতে উভয়েরই মন খারাপ হয়ে পড়ে। এছাড়া এতে থাকে স্বার্থপর স্বার্থপর ভাব। এজন্য ভাল আছি বলে প্রশ্নকর্তার মনটাকে খুশি রাখা হয়। কারন আমি যেন ভাল থাকি এটাই তো প্রশ্নকর্তা চান। তিনি যা চান তাই তাকে বলে দেয়া হয়। কিন্তু সর্ব েেত্র এই ফর্মূলা কাজে লাগে না। আমার বন্ধুটিও এই ফর্মূলা মানলো না। বললো সব কথাই বুঝলাম, কিন্তু বন্ধুকে খুশি করার জন্য গোজামিলে ভাল থাকার এই নোংড়া রাজনীতি কেন? ভাবলাম সেও নাছোড়বান্দা। তাই একটুখানি মেজাজ দেখিয়ে বললাম, ‘আমি ভাল আছি’ তাই ভাল বলেছি, শত সমস্যার মধ্যে আমার সন্ত্বনা আছে, সমাধান আছে। আমার এই মেজাজী কথায় সে না মানার ভাব-ভঙ্গিমূলক হাসি হেসে চুপ করলো; কিন্তু চুপ হওয়ার আগে অবশ্য বললো ঃ থাক ভাই থাক, তুমি ভালই থাক। ভাল থাকার ব্যাপারটা একটুখানি জটিল বৈকি। ভাল না থেকেও যে ভাল বলা হচ্ছে তাতেই বাধচ্ছে নানা গন্ডগোল। এ দুনিয়াতে এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবে না যার জীবনে কোন সমস্যা বা সংকট নেই। সমস্যা আর সংকটের মধ্যে দিয়ে চলার নামই তো জীবন। কিন্তু সমস্যা আছে বলেই যে সর্বদা প্রকাশ করে বেড়াতে হবে, যার সঙ্গে দেখা হবে তাকে বলতে হবে, ‘আমি ভাল নেই, মন্দ আছি’ এর তো কোন মানে নেই, অর্থ নেই। আমার হাড়িঁর চাল আমাকেই জোগাড় করতে হবে। শূন্য হাড়ি গলায় ঝুলিয়ে দশজনের দৃষ্টি আর্কষণ করা হীনমন্যতা ছাড়া কিছু নয়। আমাকে যা দেয়া হয়েছে হিসাব তারই নেয়া হবে। আমার সমস্যা কিন্তু আমার, সে সমস্যা সাধ্যের সীমানায় সীমিত । সমাধানও সেখানে নিহিত। কোটিপতির বিত্তের প্রতি তাকিয়ে আফসোস করে নিজের কপালে ঠুকর মারার কোন মানে হয় না। কোটিপতির সম্পদের অংশীদারও হবার লোভ যদি থাকে তাহলে কোটিপতির ঝামেলা আর সমস্যার অংশীদারও তো হতে হবে, পারবো কি প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সেই বোঝা বহন করতে?
সুতরাং মোটামোটি হিসাবে যেমন আছি তেমনই ভাল আর সেই ভাল যদি সম্পদের না হয়ে চরিত্রের হয় তাহলে আরও ভাল। ভাল আছি না মন্দ আছি তা বলার দরকার নেই। কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে যদি আলহামদুলিল্লাহ বলা যায় তাহলে নতুন করে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। আমার ভাল মন্দের মালিক যিনি তার হাওলায় নিজেকে সোপর্দ করে দিলে কোন ঝামেলা পোহাতে হয়না। অবশ্য আলহামদুলিল্লাহ যদি প্রাণহীন রেওয়াজে পরিণত হয়, উচ্চারিত পবিত্র কথায় যদি উচ্চারণকারীর ঈমান আমল না থাকে তা’হলে তা হবে আর এক ধররের মোনাফেকী। তবুও আলতু ফালতু কথা বলার চেয়ে এটা বলা অনেক ভাল। একদিন হয়তো তা ঈমানী আমলে পরিণত হতে পারে।
কোন পথকে অবলম্বন করবেন তা ভেবে চিন্তে দেখবেন, তবে যেমনই থাকুক না কেন ভাল না থাকার ব্যাপারে মিথ্যা মোনাফেকীর আশ্রয় যেন কেউ না নেই। সকল ভাল মন্দ সর্বশক্তিমানের উপর ছেড়ে দিয়ে জবাবটা দিলে নিজের কোন ঝামেলা থাকে না।
এবার সকলের কাছে আমার প্রশ্ন -
-কেমন আছেন? ##
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন