রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০১১

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কবলে মুসলিম বিশ্ব ইহুদি-খ্রিস্টান চক্রের সুদুরপ্রসারী ষড়যন্ত্র মুহাম্মদ নুরউদ্দিন কাওছার

১৮৯৫ সালের শেষ দিকে নিউইয়র্ক থেকে দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। একটি সানডে ওয়ার্ল্ড অপরটি সানডে জার্নাল। কে কত বেশি লোককে হাসাতে বা কাঁদাতে পারে, কে কত আশ্চর্য খবর জানাতে পারে, কে কত অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য ফিচার ও গল্প ছাপতে পারে, সে প্রতিযোগিতায় কর্মকর্তারা সর্বদা ব্যস্ত থাকেন। চমক লাগানোর জন্য শুরু হয় মিথ্যার আশ্রয় নেয়া। শুরু হয় ইয়োলো জার্নালিজমের যাত্রা। তথ্য পরিবেশনের চেয়ে উদ্দেশ্য ও অভিসন্ধি চরিতার্থ করাই এর মূল লক্ষ্য। কাগজের অতিরিক্ত কাটতির জন্য যৌনতা, হিংসা, জিঘাংসা, কেলেংকারী, অপরাধ, মিথ্যাচার, অপবাদ ইত্যাদি বিষয়ক সংবাদ সৃষ্টি করে পরিবেশন শুরু হয়। এটি তাদের দৈনন্দিন কাজে পরিণত হয়। তারা এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করল যার ভাষা শুনে শয়তানও শরম পায়। অবশেষে ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেল নগরীতে অনুষ্ঠিত হয় ইহুদী সাংবাদিকদের মহাসম্মেল। ৩০০ ইহুদী বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হার্টজালের নেতৃত্বে সেখানে সমবেত হয়। তৎকালীন বিশ্বের ৩০টি ইহুদী সংগঠনের সবচেয়ে বেশি মেধাবী ৩০০ জন এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে বিশ্বের ওপর ইহুদীদের প্রভাব বিস্তারের জন্য ১৯টি প্রটোকল গ্রহণ করা হয়। তম্মধ্যে দ্বাদশতম খসড়াটি ছিল বিশ্বের সংবাদ পত্রকে কিভাবে ইহুদী কব্জায় আনা যায় এর বিস্তারিত বর্ণনা ও পথ নির্দেশনা বিশেষ।  দ্বাদশতম খসড়ার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, ‘এমনকি প্রয়োজনবোধে আমরা (ইহুদীরা) এ ধরনের পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতাও করবো, যেগুলো বিচ্ছিন্নতা, পথভ্রষ্টতা, নেতিকতা ও চারিত্রিক অবক্ষয়, স্বৈরাচারী সরকার ও একনায়কদেরও সমর্থন করবে। আমরা যখন ও যেখানে ইচ্ছা জাতির অনুভূতিকে উত্তেজিত করে তুলবো। আমরা ইহুদীরা এমন ধরনের পরিবেশক, সম্পাদক, প্রতিবেদক ও কলামিস্টদের উৎসাহিত করতে থাকবো, যারা হবে সর্বাধিক লম্পট ও অসচ্ছরিত্র এবং যাদের অপরাধের রেকর্ড থাকবে’। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে ইহুদী ও খ্রীস্টান একই লক্ষ্যে মৈত্রী বন্ধন গড়ে তোলে। মুসলমানরা যাতে সাংস্কতিক দিক থেকে মোটেও অগ্রসর হতে না পারে এজন্য তারা তাদের দ্বাদশতম প্রটোকল অনুযায়ী  শুরু করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, যার নগ্ন বহি:প্রকাশ হলো বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এর মাধ্যমে তারা যুব সমাজকে বিপদগামী করার জন্য আয়োজন করছে বিভিন্ন চাকচিক্যময়, নোংরা অনুষ্ঠানের । একটু গোড়ার দিকে ফিরলে আমরা দেখতে পাই ৯০ এর দশকে এদেশে “বিশ্ব ভালবাসা দিবস” হিসেবে আসন গেড়ে বসে এ নব্য সংস্কৃতি। আমাদের দেশে প্রথম “যায়যায় দিন” পত্রিকায় ৯৩ সালে “ভালবাসা দিবস” সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই থেকে এ দেশের সকল মিডিয়ায় এটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে নেয়। এদিনে তরুন-তরুনী ও প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরকে শুভেচ্ছা কার্ড ও উপহার সামগ্রী পাঠায়। একে অপককে ভালবাসার কথা জানায়। শুধু প্রেমিক প্রেমিকারাই নয় ভ্যালেন্টাইন ডে তে সবাই অর্থাৎ মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান, শিক্ষক, সহকর্মীরা ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান নানা ভাবে। চরিত্র হননের হাতিয়ার ও নীতি নৈতিকতার স্থলনজনিত কারণসহ আনুষ্ঠানিক মারাত্মক কিছু সমস্যা কারণে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইনসডে পালনকে নিষিদ্ধি ঘোষাণা করেন। পরবর্তীতে ইতালী, অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী ও জার্মানী ফ্রান্সের পথে হাঁটে । এর আগে ১৭ শতকে রক্ষণশীল খ্রীষ্টানদের আধিপত্যের কারণে ইংল্যান্ডে ও এসব উৎসব পালন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৭৯০ সালে রাজা কার্লোস দ্বিতীয় এটা আবার পুনরুজ্জীবিত করেন।
মহান আলাহ এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেছেন, “হে নবী আপনি মুমিন যুবকদেরকে বলেন তোমরা তোমদের চক্ষুযুগল অবনমিত কর (আর যুবতীদের দিকে তাকানো থেকে বিরত হও) এবং নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাজত কর। হে নবী আপনি মুমিন (যুবতীদেরকে) বলেন তারা ও যেন তাদের দৃষ্টিকে নত করে অপর কোন পুরুষের দিকে চোখ না দেয় এবং তাদের সম্ভ্রমকে রক্ষা করে”। কোরআনের এসব আয়েতের মাধ্যমে বুঝা যায় ব্যভিচার করাতো দূরের কথা তার কাছেও যাওয়া যাবে না। ভালবাসা দিবস যেনা নয় কিন্তু এটি যেনাকে উৎসাহিত করে এক সময় ব্যভিচারে লিপ্ত করে। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ও চলছে চরম দেওলিয়াত্ব। চলছে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির চর্চা। অপসংস্কৃতির বিভীষিকা থেকে মুসলিম সংখ্যাঘরিষ্ঠ দেশ ও বিশ্ব মানবতাকে রক্ষা ও বিরত বাখতে না পারলে হযরত লুত (আঃ) এর কাওমের মত এমনকি তার চেয়েও ভীষণ কোন খোদায়ী গজব নাযিল হয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে পারেন। তাই এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে সকল পর্যায় থেকে। যার সমাধান ১৪০০ বছর আগে পবিত্র কোরআন এভাবে দিয়েছেন যখন অওউঝ এর কোন ধারণা বিশ্ব সভ্যতা জানতনা “ব্যভিচারিনী ও ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশো কষাঘাত মারবে। আল্লাহর বিধান কার্যকারী করণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের অভিভূত* না করে,  বিশ্ববাসীদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (আন-নূর-২) 
তথাকথিত সভ্যতার দাবীদার পশ্চিমা দেশগুলো নারীকে ঘর থেকে বাইরে টেনে এনে সেক্স ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল বানানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নগ্নতা, অশীলতা ও বেহায়াপনার প্রতিযোগিতায লিপ্ত হয়েছে। তাই থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশের পর্যটন শিল্পগুলো সবই নারী কেন্দ্রিক হয়ে গড়ে উঠেছে। আবুল হাশেম তার ‘ঈৎববফ ড়ভ ওংষধস’ গ্রন্থের ২৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘রাশিয়া পিতা ও কন্যা, মাতা ও পুত্র এবং ভ্রাতা ও ভগ্নীর যৌন মিলনের ফলাফল পরীক্ষা করে দেখেছে। স্থানীয় বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা এতে শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির তেমন কিছু দেখতে পাননি। কাজেই সে দেশের সরকার এরূপ মিলনকে এদিক থেকে অন্যায় ও দোষণীয় মনে  করেন না। তবে যারা বিবাহ প্রথাকে পছন্দ করেন তাদের নিরুৎসাহিত করতেও ইচ্ছুক নন। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে মানব সমাজ আবার ধীরে ধীরে আদিম বর্বর সমাজের দিকে ফিরে যাচ্ছে। ধর্ম বা সামাজিক বিধি-নিষেধ এখানে প্রতিবন্ধক নয়। যার যেমন খুশি সে চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় অবাধে লিভটুগেদার করবে। সমকামিতার এ কাজ অতিশয় কদর্য, বীভৎস ও বদ-অভ্যাস  আর আল্লাহর দৃষ্টিতে মারাত্মক গুনাহের কাজ। এর ফলে মানুষের জীবনীশক্তি ও প্রজনন ক্ষমতা চিরতরে নি:শেষ হয়ে যায়। যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ নারী-পুরুষ সৃষ্টি করেছেন এসব কাজে তা বিনষ্ট ও ব্যর্থ হয়ে যায়। এর ফলে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়ে যায়। ঠিক এ কারণেই ইসলাম যৌন স্পৃহা পূরণের এসব অন্ধকারাচ্ছন্ন গলি ও বাঁকা চোরা পথ অবলম্বন চিরতরে হারাম করে দিয়েছে।  সমকামিতা সম্পর্কে কুরআনে কঠোর হুঁশিয়ারী ও সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। লুত (আ.) এর পুরুষদেরকে এভাবে জিজ্ঞসা করা হয়েছে তাদের এ বদ-অভ্যাস সম্পর্কে- ‘তোমরা পুরুষেরা  দুনিয়ার পুরুষদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছ, আর ত্যাগ করছ তোমাদের জন্য সৃষ্ট তোমাদের স্ত্রীদের? তোমরা হচ্ছ সীমালঙ্ঘনকারী লোক’ (সূরা শুয়ারা-১২৫-১২৬) । হাদীস শরীফে এ অপরাধের দন্ড হিসেবে বলা হয়েছে- ‘ যে দুজনকে তোমরা লেওয়াতাতের (সমমৈথুন) কাজ করতে দেখতে পাবে, তাদেরকেই তোমরা হত্যা করবে’(তিরমিযী)।
তাই ইসলাম ভালবাসাকে শুধু একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং ভালবাসার সীমানাকে অনেক বেশি প্রসারিত করেছে। আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীদের প্রতি ভালবাসা, ভাল ও নেক লোকদের প্রতি ভালবাসা ও আখিরাতের প্রতি ভালবাসা, পিতা-মাতা, সন্তান, ভাই-বোন ও স্ত্রী-পরিজনের প্রতি ভালবাসা, অসহায় মানুষের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি। পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও সম্প্রীতির ব্যাপারে ইসলাম যতটা তাগিদ দিয়েছে ততটা পৃথিবীর আর কোন ধর্মে পাওয়া যাবে না। ইসলামে ভালবাসা প্রকাশের কোন নির্দিষ্ট দিন ও ক্ষণ নেই। সব সময় অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও ভালবাসা প্রকাশকে উৎসাহিত করেছে ইসলাম। মহানবী (সাঃ) বলেছেন: ‘‘তোমাদের কেউ যখন তার ভাইকে ভালবাসবে তার উচিত এ ভালবাসার কথা তাকে জানানো” (আবু দাউদ, তিরমিযি)। মহানবী (সাঃ) আরো বলেছেন, “যার হাতে আমার জীবন সে মহান সত্তার শপথ করে বলছি, তোমরা বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করতে সক্ষম হবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরের প্রতি ভালবাসা পোষণ কর। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজের কথা বলব যেটি করলে তোমাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে? তোমরা পরস্পরকে সালাম দেয়ার প্রচলন কর” (মুসলিম)। এ হাদিসে ভালবাসাকে জান্নাতে প্রবেশের পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ইসলাম প্রাণহীন জড় বস্তুর প্রতিও ভালবাসা পোষণের কথা বলে। তাই তো মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “এটা ওহুদ পাহাড়। এ পাহাড়কে আমরা ভালবাসি আর এ পাহাড়ও আমাদেরকে ভালবাসে।” ইসলাম দিবস নির্ভর ভালবাসার অনুমোদন দেয়নি। তবে ভালবাসার অনেক উপায় আছে যেগুলো ইসলামী সংস্কৃতিরই অংশ। কারণ দিন ক্ষণ ঠিক করে ভালবাসা যায় না, এরূপ ভালবাসা কৃত্রিম। আল্লাহ বলেন-‘যারা ঈমান এনেছে তাদের সর্বোচ্চ ভালবাসা আল্লাহর জন্য’ (সূরা বাকারাহ-১৬৫)। রাসূল (স.) বলেছেন-‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আমার সুমহান ইজ্জতের খাতিরে যারা পরস্পরে ভালবাসা স্থাপন করেছে তারা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়ায় স্থান দিব। আজ এমন দিন, আমার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া নেই’ (মুসলিম)।

অফিসার,
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড,
শরী’আহ্ সেক্রেটারিয়েট, হেড অফিস,

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন