সত্যিই অবাক হলো আলিমদ্দি দফাদার। মাথার সামনের দিকটা থেকে চুল পড়ে যাওয়ায় কপালের সাইজটা বেড়ে যে সাড়ে তিন আঙুলের জায়গায় প্রায় পাঁচ আঙুল হয়েছে, সেই কপালটাতে সাড়ে চারটা মতো ভাঁজ পড়লো। অন্তত মিরাজ সে কয়টাই গুণে পেল।
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটে বার তিনেক চিমটি কাটল আলিমদ্দি। তারপর বলল, ‘তুমি সত্যিই আমারে চিন্তাই ফালায়ে দিলে মিরাজ। হাবুল ছ্যামড়াডা (ছোড়াটা) এরম একটা কা ঘটায় ফ্যালবে এইটে আমি মানতিই পাচ্ছিনে। বড়ই চিন্তার বিষয়!’
গভীরভাবে কিছু ভাবতে লাগল আলিমদ্দি।
‘আমিউ কি প্রত্থমে বিষয়ডা বিশ্বাস কত্তি পারিছি?’ বলল মিরাজ। ‘নিজির চোখি না দেকলি তো কোনোমতেই বিশ্বাস কত্তাম না।’
‘হু!’ বিশেষ ভঙ্গিতে মুখের সামনে দিয়ে ডান হাতটা ঘুরিয়ে বলল আলিমদ্দি দফাদার। ‘কিন্তু আমি ভাবতিছি অন্য কথা।’
‘এর মধ্যি আবার অন্য কথা কনে পেলেন?’ একটু যেন মিইয়ে গেল মিরাজ।
ডান পায়ের উপর শরীরের সমস্ত ভর ন্যস্ত করে বাম হাতের তালুর উপর ডান হাতের একটা ঘুষি চালিয়ে বলল আলিমদ্দি, ‘আচ্ছা সত্যি করে কও তো মিরাজ, এর মধ্যি অন্য কোনো কারণ নেই তো? মানে আমি কতি চাচ্ছি...’
এবার সত্যি সত্যিই ভড়কে গেল মিরাজ। আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিমায় বলল, ‘আপনি চাচাজান আমার কথা কি বিশ্বাস কত্তিছেন না? মানে হাবুল যে সত্যিই গতকাল রাত্তিরবেলা...’
মিরাজকে থামিয়ে দিল দফাদার। বলল, ‘না সে কথা কচ্ছিনে, এই মনের মধ্যি খালি একটু সংশয় জাগতিছিল তাই কলাম আরকি। তা ছ্যামড়াডা এখন কনে আছে?’
‘ওদের বাড়িতিই আছে।’ জবাব দিল মিরাজ। তারপর বলল, ‘আমি তা’লি এখন যাই চাচাজান!’
‘হ্যাঁ তা তো যাবাই। দেখি, সুযোগ করে ছ্যামড়াডারে একবার দেখে আসবানে। হাজার হলিউ ল্যাংড়া ভূতে ধরেছে বলে কথা!’
‘আমি যাই চাচাজান, সালামু আলাইকুম।’ দ্রুত সটকে পড়ল মিরাজ।
আলিমদ্দি দফাদার কয়েক মুহূর্ত তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আপনমনেই বলল, ‘যত্তোসব আজগুবি বিষয়! নিশ্চই কোনো ধান্দা নিয়ে এই কাম করেছে হাবুল ছ্যামড়াডা।’
বুকের সামনে দেড় ইঞ্চি বেড়ে যাওয়া পেটটা আরও প্রায় আধা ইঞ্চি ফুলিয়ে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিপরীত পথ ধরল আলিমদ্দি।
* * *
সামনের শিমুল গাছটাতে একটা ভাত শালিক ডেকে চলেছে অনবরত। পুকুর পাড়ের এই শিমুল গাছটা শীতের সময় লাল টুকটুকে ফুলে ভরে যায়। তখন কোনো পাতা চোখে পড়ে না। সেই রাঙা শিমুল ফুলে ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ায় শালিক পাখি আর সঙ্গীদের সাথে কিচিরমিচির কূজন তুলে মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে। সারাদিন রং আর সৌন্দর্য ছড়িয়ে ফুলেরা বুঝি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ফুলের উপর সেই ভারটা ছেড়ে দিতেই যেন বোঁটার গোড়াটা আলগা করে দেয়। আর তাতেই গাছের ডাল থেকে একেবারে ধরাপাত। অবশ্য দিনেও যে ঝরে পড়ে না তা নয়। তবে রাতেই বোধহয় বেশি ক্লান্তি বোধ করে তারা। অন্তত ভোরে গাছতলাটা ঝরা ফুলে ভরে থাকতে দেখে সেটাই মনে করা স্বাভাবিক।
একটু ঘোর ঘোর থাকতেই গ্রামের ছেলেরা, অনেক সময় মেয়েরাও, সেই ঝরা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যায় বস্তা বা ঝুড়ি ভরে। ঘোর থাকতেই আসার কারণ হচ্ছে পাছে অন্য কেউ ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যায়! এই ঝরা শিমুল ফুল পোষা ছাগলের বেশ প্রিয় খাদ্য।
ক্যালেন্ডারের পাতায় শীত এখনও শুরু হয়নি। হেমন্তের আরও কয়েকদিন বাকি আছে। এরই মধ্যে শিমুল গাছটাতে ফুলের মুকুল চলে এসেছে। মুকুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। ছেলেমেয়েরা এই মুকুল নিয়ে অনেক সময় খেলায় মেতে ওঠে। কেউ বা অফুটন্ত মুকুলকে হাত দিয়ে ফুটিয়ে দিতে কসরত শুরু করে দেয়। কিন্তু এভাবে ফোটানো ফুল তো আর সত্যিকার ফুটন্ত ফুলের মতো লাগে না।
আগের ভাত শালিকটার পাশে এখন আরেকটি শালিককে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত সঙ্গীর ডাকে সাড়া দিতেই হাজির হয়েছে। এবার দুটোতে লেজ ও ঠোঁট নাড়িয়ে চমৎকার এক খেলায় মেতে উঠল। তাই দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল সাইফুলের। গতকালই শহর থেকে গ্রামে এসেছে ও। শহর বলতে ঢাকাতে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। এমনিতেই ছুটিছাটা খুব একটা পায় না। তাই বাড়ি আর গ্রামের জন্য মনটা কেমন কেমন করলেও ইচ্ছে মতো যখন তখন ছুটে আসতে পারে না। শহরের ইট-কংক্রিটের নিরেট খাঁচায় বন্দি থাকলেও গ্রামের কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না ও। অবসর খুব একটা মেলে না, কিন্তু যখনই সামান্যতমও একটু সুযোগ পায়, তখনই মনের পর্দায় বায়োস্কোপের মতো সব ভেসে ওঠে। স্পষ্ট চোখের সামনে সব কিছু দেখতে পায় ও তখন। কী যে ভালো লাগে তখন! কিন্তু মনের অন্য কোণটিতে পরবর্তী দিনের কাজের হিসাব ঠিকই উঁকি দিতে থাকে। কোম্পানির পলিসিগুলো যেন কেবল মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার তালে থাকে। তাই সুখের সাগরে সাম্পান ছেড়ে দিয়ে বেশিক্ষণ বিচরণ করা সম্ভব হয় না সাইফুলের জন্য। তখনই মনটা আবার বেদনায় ভারক্রান্ত হয়ে পড়ে। আহ্! কতই না মধুর ছিল সেই দিনগুলো! আবারও যদি ফিরে যাওয়া যেত, তাহলে কিছুতেই সেখান থেকে বের হওয়ার কথা ভাবত না।
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটে বার তিনেক চিমটি কাটল আলিমদ্দি। তারপর বলল, ‘তুমি সত্যিই আমারে চিন্তাই ফালায়ে দিলে মিরাজ। হাবুল ছ্যামড়াডা (ছোড়াটা) এরম একটা কা ঘটায় ফ্যালবে এইটে আমি মানতিই পাচ্ছিনে। বড়ই চিন্তার বিষয়!’
গভীরভাবে কিছু ভাবতে লাগল আলিমদ্দি।
‘আমিউ কি প্রত্থমে বিষয়ডা বিশ্বাস কত্তি পারিছি?’ বলল মিরাজ। ‘নিজির চোখি না দেকলি তো কোনোমতেই বিশ্বাস কত্তাম না।’
‘হু!’ বিশেষ ভঙ্গিতে মুখের সামনে দিয়ে ডান হাতটা ঘুরিয়ে বলল আলিমদ্দি দফাদার। ‘কিন্তু আমি ভাবতিছি অন্য কথা।’
‘এর মধ্যি আবার অন্য কথা কনে পেলেন?’ একটু যেন মিইয়ে গেল মিরাজ।
ডান পায়ের উপর শরীরের সমস্ত ভর ন্যস্ত করে বাম হাতের তালুর উপর ডান হাতের একটা ঘুষি চালিয়ে বলল আলিমদ্দি, ‘আচ্ছা সত্যি করে কও তো মিরাজ, এর মধ্যি অন্য কোনো কারণ নেই তো? মানে আমি কতি চাচ্ছি...’
এবার সত্যি সত্যিই ভড়কে গেল মিরাজ। আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিমায় বলল, ‘আপনি চাচাজান আমার কথা কি বিশ্বাস কত্তিছেন না? মানে হাবুল যে সত্যিই গতকাল রাত্তিরবেলা...’
মিরাজকে থামিয়ে দিল দফাদার। বলল, ‘না সে কথা কচ্ছিনে, এই মনের মধ্যি খালি একটু সংশয় জাগতিছিল তাই কলাম আরকি। তা ছ্যামড়াডা এখন কনে আছে?’
‘ওদের বাড়িতিই আছে।’ জবাব দিল মিরাজ। তারপর বলল, ‘আমি তা’লি এখন যাই চাচাজান!’
‘হ্যাঁ তা তো যাবাই। দেখি, সুযোগ করে ছ্যামড়াডারে একবার দেখে আসবানে। হাজার হলিউ ল্যাংড়া ভূতে ধরেছে বলে কথা!’
‘আমি যাই চাচাজান, সালামু আলাইকুম।’ দ্রুত সটকে পড়ল মিরাজ।
আলিমদ্দি দফাদার কয়েক মুহূর্ত তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আপনমনেই বলল, ‘যত্তোসব আজগুবি বিষয়! নিশ্চই কোনো ধান্দা নিয়ে এই কাম করেছে হাবুল ছ্যামড়াডা।’
বুকের সামনে দেড় ইঞ্চি বেড়ে যাওয়া পেটটা আরও প্রায় আধা ইঞ্চি ফুলিয়ে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিপরীত পথ ধরল আলিমদ্দি।
* * *
সামনের শিমুল গাছটাতে একটা ভাত শালিক ডেকে চলেছে অনবরত। পুকুর পাড়ের এই শিমুল গাছটা শীতের সময় লাল টুকটুকে ফুলে ভরে যায়। তখন কোনো পাতা চোখে পড়ে না। সেই রাঙা শিমুল ফুলে ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ায় শালিক পাখি আর সঙ্গীদের সাথে কিচিরমিচির কূজন তুলে মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে। সারাদিন রং আর সৌন্দর্য ছড়িয়ে ফুলেরা বুঝি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ফুলের উপর সেই ভারটা ছেড়ে দিতেই যেন বোঁটার গোড়াটা আলগা করে দেয়। আর তাতেই গাছের ডাল থেকে একেবারে ধরাপাত। অবশ্য দিনেও যে ঝরে পড়ে না তা নয়। তবে রাতেই বোধহয় বেশি ক্লান্তি বোধ করে তারা। অন্তত ভোরে গাছতলাটা ঝরা ফুলে ভরে থাকতে দেখে সেটাই মনে করা স্বাভাবিক।
একটু ঘোর ঘোর থাকতেই গ্রামের ছেলেরা, অনেক সময় মেয়েরাও, সেই ঝরা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যায় বস্তা বা ঝুড়ি ভরে। ঘোর থাকতেই আসার কারণ হচ্ছে পাছে অন্য কেউ ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যায়! এই ঝরা শিমুল ফুল পোষা ছাগলের বেশ প্রিয় খাদ্য।
ক্যালেন্ডারের পাতায় শীত এখনও শুরু হয়নি। হেমন্তের আরও কয়েকদিন বাকি আছে। এরই মধ্যে শিমুল গাছটাতে ফুলের মুকুল চলে এসেছে। মুকুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। ছেলেমেয়েরা এই মুকুল নিয়ে অনেক সময় খেলায় মেতে ওঠে। কেউ বা অফুটন্ত মুকুলকে হাত দিয়ে ফুটিয়ে দিতে কসরত শুরু করে দেয়। কিন্তু এভাবে ফোটানো ফুল তো আর সত্যিকার ফুটন্ত ফুলের মতো লাগে না।
আগের ভাত শালিকটার পাশে এখন আরেকটি শালিককে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত সঙ্গীর ডাকে সাড়া দিতেই হাজির হয়েছে। এবার দুটোতে লেজ ও ঠোঁট নাড়িয়ে চমৎকার এক খেলায় মেতে উঠল। তাই দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল সাইফুলের। গতকালই শহর থেকে গ্রামে এসেছে ও। শহর বলতে ঢাকাতে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। এমনিতেই ছুটিছাটা খুব একটা পায় না। তাই বাড়ি আর গ্রামের জন্য মনটা কেমন কেমন করলেও ইচ্ছে মতো যখন তখন ছুটে আসতে পারে না। শহরের ইট-কংক্রিটের নিরেট খাঁচায় বন্দি থাকলেও গ্রামের কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না ও। অবসর খুব একটা মেলে না, কিন্তু যখনই সামান্যতমও একটু সুযোগ পায়, তখনই মনের পর্দায় বায়োস্কোপের মতো সব ভেসে ওঠে। স্পষ্ট চোখের সামনে সব কিছু দেখতে পায় ও তখন। কী যে ভালো লাগে তখন! কিন্তু মনের অন্য কোণটিতে পরবর্তী দিনের কাজের হিসাব ঠিকই উঁকি দিতে থাকে। কোম্পানির পলিসিগুলো যেন কেবল মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার তালে থাকে। তাই সুখের সাগরে সাম্পান ছেড়ে দিয়ে বেশিক্ষণ বিচরণ করা সম্ভব হয় না সাইফুলের জন্য। তখনই মনটা আবার বেদনায় ভারক্রান্ত হয়ে পড়ে। আহ্! কতই না মধুর ছিল সেই দিনগুলো! আবারও যদি ফিরে যাওয়া যেত, তাহলে কিছুতেই সেখান থেকে বের হওয়ার কথা ভাবত না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন