রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০১১

পরিবার শিশুর মানসিক বিকাশের শ্রেষ্ঠতম কারিগর আবু সালেহ

 

মাতৃগর্ভে ২৮০ দিন অবস্থানের পর  নবজাতক ভূমিষ্ট হয়। পৃথিবীর আলো ঝলমলে নতুন পরিবেশে শিশুকে চমকে দেয়। কান্নার মাধ্যমে শিশু তার প্রথম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। নতুন পার্থিব পবিবেশের সাথে খাপ খেয়ে শিশু বড় হতে থাকে ও বংশগত সূত্রে জন্মলাভকারী শিশু পরিবেশের সাহায্যে এ গিয়ে যায় অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। বিশ্ব জোড়া পাঠশালা যেন সবারই সে ছাত্র। নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখে দিবা রাত্র রঙিন ফুল-ফল, সবুজ-শ্যামল মাঠ,  পাখির কলরব, নীলিমার আকাশ বাতাস, মায়ের মুখের হাসি সব কিছুর মাঝেই যেন নতুন কিছু খুঁেজ পায় আর নিজের অজান্তেই মিষ্টি ঠোঁটে ডুরে হেসে দেয়। প্রকৃত পক্ষে শিশুর জীবনের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে তার পরিবার। আর এই সেরা প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হচ্ছেন ঐ শিশুটির মমতাময়ী মা। তার পরে বাবা অত:পর পরিবারের অন্যান্য সদস্য। সেজন্যই বুঝি দেশ-বিদেশের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুর ভর্তির জন্য শর্ত থাকে শিশুর মাকে অবশ্যই পোষ্ট গ্রাজুয়েট বা মাস্টার্স পাশ হতে হবে। সাধারণত প্রতিটি মাবন শিশুর মধ্যেই লুক্কায়িত থাকে আসাধারণ মানবিক প্রতিভা। যার বিকাশ ঘটে কেবল উপযুক্ত পরিবেশের মাধ্যমে। প্রতিটি শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য যতটুকু সামাজিক শিক্ষা ও পারিবারিক আদর স্নেহের প্রয়োজন তা অনেক শিশুই হয়ত পায় না। অথচ আগামীদিনের ভবিষ্যৎ কর্ণধার এই শিশুটির জন্য এ গুলো হচ্ছে সর্বাপেক্ষা মৌলিক ও প্রাথমিক অধিকার। এই সুবিধা যে শিশু যত বেশি পায় তার মানবিক বিকাশ ততটা উন্নত । তাহলে প্রিয় পাঠক আসুন এবার আমরা দেথি এ বিষয়ে গবেষণা রিপোর্ট কি বলে।
ফেরেল মানব ঃ যে সকল মানব শিশু মানব সমাজের বাইরে ৎ বা বন্য পেিবশে লালিত পালিত হয়েছে তাদেরকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ফেরেল মানব। এই ধরনের শিশুরা বাঘ, ভল্লুক, শৃৃগাল প্রভৃতি বণ্য প্রাণীর আশ্রয়ে বড় হয়। বন্য পশু পালিত মানব শিশুর এক উজ্জল দৃষ্টান্ত দিয়েছেন জে সিং ১৯৩০ সালে মি.সিং এবং তার স্ত্রী ভারতের মেডিদনাপুর অঞ্চলের নেকড়ে পালিত দুটি মানব শিশু কন্যা উদ্ধার করে মানব সমাজে নিয়ে আসেন। তারা বড় মেয়েটির নাম দেন কমলা এবং ছোটটির নাম অমলা। যখন এদের সমাজে আনা হয় তখন কমলার বয়স হয়েছিল ৮ এবং অমলার বয়স দেড় বছর। উদ্ধারের কিছুকাল পরেই অমলা মারা যায়। কমলা প্রায় সতের বছর বয়স পর্যন্ত বেঁেচছিল। এই নয় বছরকাল মি. সিং এবং মিসেস সিং মধূর ব্যবহারের মাধ্যমে কমলাকে মানবোচিত আচরণ অভ্যাস ও ভাষা শেখাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
উদ্ধার উত্তর কমলার আচরণঃ
১। কমলাকে যখন উদ্ধার করা হয় তখন সে কনুই ও হাঠুর উপর ভর দিয়ে চলত।
২। দৌড়াত দু’হাত ও দু’পায়ের উপর ভর করে।
৩। রান্না করা খাবার খেত না, কাচা মাংস খেয়ে তৃপ্তি পেত।
৪। মেঝেতে দিলে চেটে পানীয় পান করত।
৫। দিনের বেলায় ঘুমাত এবং সারারাত ইতস্তত বিচরন করে বেড়াত।
৬। সে জন্তুর মতো আওয়াজ করত কথা বলতে পারতো না।
৭। কাছে গেলে গর্জন করে উঠত।
৮। রাত্রিবেলায় সে ভাল খেতে পেত কিন্তু তীব্র আলো ও আগুন দেখলে সে ভয় পেত।
কমলা ১৭বছর পর্যন্ত বেঁেচছিল। ১৭ বছর তার বুদ্ধি বৃত্তি কিছুটা বিকাশ ঘটলেও তা স্বাভাবিক শিশুর চার বছরের মানসিক বিকাশকে অতিক্রম করতে পারেনি।
কমলা আমাদের মতই ইন্দ্র্রিয় পেশীর ও স্নায়ুতন্ত্রের অধিকারী ছিল। কিন্তু জন্মবধি মানব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় সে মানব সমাজের কোন শিক্ষা পায়নি। পায়নি কোন মানবিক স্নেহ ও আদর যতœ। তাই তার মধ্যে মানুষের কোন গুনই পরিষ্ফুটন হয়নি।
আবার, কিংস্লে ডেবিস মানুষ্য সমাজ থেকে জন্মবথিধ দীর্ঘকাল ব্যাপি ইসাবেলা নামের ১টি শিশুর বিচ্ছিন্ন পরিনামের কথা উল্লেখ করেছেন। ইসাবেলা তার বধির ও বোবা মায়ের সাথে সাড়ে ছ বছর একটি বিচ্ছিন্ন কক্ষে ছিল। সাড়ে ছয় বছর পর যখন তাকে উদ্ধার করা হয়ল, তখন তার মধ্যে অনেক মানবিক গুন অনুপস্থিত ছিল। প্রশিক্ষনের ফলে দু’বছরে সে ভালেভাবে কথা বলতে শেখে এবং তার বুদ্ধি বেড়ে যায় তিনগুন।
সুতরাং বিষয়টি একেবারেই পরিস্কার যে শিশুর মানসিক বিকাশে পরিবেশের ভূমিকা অপরীসিম। তাই শিশু কে সত্যিকার যোগ্য মানুষ রূপে গড়ে তুলতে হলে তাকে অবশ্যই জ্ঞান বিকাশের কাঙ্খিত পরিবেশ দিতে হবে। আদর, স্নেহ ও মমতা দিয়ে রাগের পরিবর্তে ভালবাসা দিয়ে শাস্তির পরিবর্র্তে ভালকাজের এটিচিউট গড়ে তুলতে হবে। প্রিয় নবী সা: বলেন “ যারা বড়দের শ্রদ্ধা করে না এবং ছোটদের স্নেহ করেনা তারা আমার দলভুক্ত নয়।” বাস্তবিক  অর্থে এই পৃথিবীতে আল্লাহ আমাদেরকে মানুষ রূপে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ হিসেবে আমরা কোন না কোন শিশুর পিতা বা মাতা ভাই কিংবা বোন, মামা, কিংবা খালা, কাকা কিংবা ফুফু যে কোনভাবেই কোনা না কোন অবুঝ শিশুটি আমার অতি কাছের। তাই আমরা কাছ থেকে যদি প্রত্যেক প্রতিটি শিশুকে একটু আদর স্নেহ ভালবাসার বিকশিত হতে সাহায্য করি তবে জাতি আগামীদিনে পেতে পারে একটি সভ্য সমাজ ও যোগ্য নেতৃত্ব। আর এর জন্য সর্ব প্রথম প্রয়োজন শিশুকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত লেখক, সার এ.জি. স্টানলি হেল এর একটি উক্তির কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছেন ওভ ুড়ঁ ঃবধপয ুড়ঁৎ পযরষফৎবহ ঃযৎবব জ’ং জবধফরহম, ডৎরমরহম ধহফ অৎরঃযসবঃরপ নঁঃ ষবধাব ঃযব ভড়ঁৎঃয জ জবষরমরড়হ, ুড়ঁ রিষষ মবঃ ধ ভরভঃয জ রঃ রং জধংপধষরঃু” অর্থাৎ যদি তুমি তোমার সন্তানকে তিনটি শিক্ষা দাও পড়া, লেখা, এবং অংক কিন্তু চতুর্থ একটি জিনিস ধর্ম শিক্ষা বা নৈতিক শিক্ষাকে বাদ দাও তাহলে তুমি পঞ্চম নম্বরে একটি জিনিস তোমার ছেলের কাছে পাবে আর এটি হচ্ছে বদমায়েশী।
অতএব আসুন আমরা সবাই কাধে কাধ, হাতে হাত মিলিয়ে একাত্মতা ঘোষনা করি যে, শিশুদের জন্য আমরা সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিত করবই। প্রয়াত তরূন কবি সুকান্তের কণ্ঠের সাথে সুর মিলাই-
“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাস যোগ্য করে যাব আমি।
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
লেখক:
বিএসসি অনার্স, এমএসসি
ফাস্ট ক্লাশ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন